কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বালিয়াড়িতে এক রাতে ১৭টি অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম পেড়েছে। সোমবার দিবাগত রাতে কক্সবাজার টেকনাফ সমুদ্র সৈকতের সোনারপাড়া ও টেকনাফ পয়েন্টে এসব কচ্ছপ মোট ১৮৯০টি ডিম পাড়ে। এটিই চার বছরের মধ্যে একরাতে সর্বোচ্চ ডিম পাড়ার রেকর্ড বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এর আগে টানা ১২ দিন ধরে মৃত সামুদ্রিক কচ্ছপ ভেসে আসার পর রোববার দিবাগত রাতে পাঁচটি অলিভ রিডলি সামুদ্রিক কাছিম মোট ৫৬৬টি ডিম পেড়ে নিরাপদে সাগরে ফিরে যায় বলে জানান বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। তিনি জানান, এরপর
সোমবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সোনারপাড়া সৈকতে তিনটি অলিভ রিডলি ২৯৩টি ডিম পেড়েছে। এসব ডিম বোরির প্রাকৃতিক হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফের বাহারছড়ার শীলখালীতে ৪টি, সদরের হাবিরছড়ায় ২টি, উখিয়ার ছেপটখালীতে ৬টি ও মাদারবুনিয়ায় ২টি স্ত্রী কচ্ছপ ১ হাজার ৫৯৭টি ডিম পেড়েছে। ডিমগুলো ফোটানোর জন্য বেসরকারি সংস্থা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (কোডেক) এর হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে ১০৩টি অলিভ রিডলি কচ্ছপ প্রায় ১১ হাজার ৮৯৫টি ডিম পাড়ে। এরমধ্যে কোডেক এর হ্যাচারীতে ৫৭টি কাছিমের ৬ হাজার ৫৬৮টি ডিম, নেকম এর হ্যাচারীতে ৪১টি কাছিমের ৪ হাজার ৭৭৭টি ডিম এবং বোরির হ্যাচারীতে ৫টি কাছিমের ৫৫০টি ডিম সংরক্ষণ করা হয়েছে।
এদিকে ৬ বছর ধরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডিম পাড়ছে না পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সামুদ্রিক কচ্ছপ হিসাবে বিবেচিত হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপ। আর ৩ বছর ধরে দেখা নেই গ্রিন টার্টল বা সবুজরঙা সামুদ্রিক কচ্ছপের। তবে গত বছর জানুয়ারি মাসে সেন্টমার্টিন ও দুবলারচর সৈকতে দুটি মৃত হক্সবিল ভেসে আসে।
সারাবিশ্বে মাত্র সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ রয়েছে। এরমধ্যে বঙ্গোপসাগরে একসময় পাঁচ প্রজাতির কচ্ছপ দেখা গেলেও সর্বশেষ দেখা যায় মাত্র তিন প্রজাতির কচ্ছপ। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই অলিভ রিডলি। বাকি এক শতাংশ গ্রিন টার্টল বা সবুজরঙা কচ্ছপ ও হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপ। কিন্তু অলিভ রিডলি কক্সবাজার সৈকতে ডিম পাড়তে আসলেও বাকি দুই প্রজাতির কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসছে না। এরমধ্যে হক্সবিল বা ভূত কচ্ছপ ৬ বছর ধরে আর ৩ বছর ধরে গ্রিন টার্টল বা সবুজরঙা সামুদ্রিক কচ্ছপ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডিম পাড়তে আসছে না বলে জানান বোরির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম। একই তথ্য জানান, কোডেক কর্মকর্তা ড. শীতল কুমার নাথ ও নেকম কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম।
তরিকুল ইসলাম জানান, হক্সবিল কাছিম ৬ বছর ধরে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ডিম পাড়তে না আসলেও গত বছর ১৪ জানুয়ারি সেন্টমার্টিনে ও ১০ জানুয়ারি দুবলারচর সৈকতে দুটি মৃত হক্সবিল দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ওয়াহিদুল আলম জানান, অলিভ রিডলির প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। হক্সবিল কাছিমও একই সময়ে ডিম পাড়ার জন্য উপকূলের দিকে আসে। আর গ্রিন কাছিম আসে জুন থেকে নভেম্বরে।
রঙিন খোলসের কারণে হক্সবিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম সামুদ্রিক কচ্ছপ হিসাবে বিবেচিত। এটি প্রবাল প্রাচীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা এবং এদের প্রধান খাদ্য স্পঞ্জ। প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে থাকা স্পঞ্জ খেয়ে এরা কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীরগুলিকে বাড়তে সাহায্য করে। এরা দৈনিক প্রায় ৪৫ কেজি পর্যন্ত স্পঞ্জ খেয়ে থাকে। হক্সবিল মাত্র কয়েক প্রজাতির স্পঞ্জ খেয়ে অন্য প্রজাতিগুলোকে বড় হতে সহায়তা করে, যাতে প্রবাল প্রাচীরে নানা প্রজাতির জীবন নিয়ে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠে। হক্সবিল টার্টল এর অভাবে সমুদ্রে ক্ষতিকর স্পঞ্জ এর বৃদ্ধি খুব বেশি বেড়ে পেতে পারে এবং ধীরে ধীরে প্রবালের শ্বাসরোধ করতে পারে। যার ফলে বর্ধনশীল প্রবাল প্রচীরগুলো মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে।
এছাড়া গ্রিন টার্টল বা সবুজ কচ্ছপ সমুদ্রের তলদেশে জন্মানো সবুজ ঘাস বা সি–গ্রাসকে পুষ্ঠির যোগান দেয়। আর একটি স্বাস্থ্যকর সামুদ্রিক ঘাসের উপর নির্ভর করে আরো অনেক প্রজাতি।
বিজ্ঞানীরা জানান, হক্সবিল প্রশান্ত, আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরসহ সারা বিশ্বের গ্রীষ্মমন্ডলীয় সমুদ্রে পাওয়া যায়। তবে কিছু উপ–ক্রান্তীয় অঞ্চলেও বাস করে। হক্সবিল ভূমধ্যসাগরে পাওয়া যায় না। এরা প্রবাল প্রাচীর, পাথুরে অঞ্চল, উপহ্রদ, ম্যানগ্রোভ, মহাসাগরীয় দ্বীপ ও অগভীর উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ করে। একটি প্রাপ্তবয়স্ক হক্সবিলের ওজন ৪৫ থেকে ৯০ কেজি এবং উচ্চতায় ২–৩ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এই কচ্ছপগুলি ছোট ছোট বিক্ষিপ্ত সৈকতে ও কম ঘনত্বে একাকি বাসায় ডিম পাড়ে। এরা প্রতি ঋতুতে ২ সপ্তাহের ব্যবধানে প্রায় ৪ বার ডিম পাড়ে। আর প্রতি বারে তারা ১৪০টি থেকে ২শ টিরও বেশি ডিম পাড়ে।