সভ্য সমাজের এ কেমন বীভৎস দৃশ্য!

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

মা- ছোট্ট এই শব্দটির মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর সমস্ত নীরবতা, গর্বিত আবেগ, নৈঃশব্দের কোলাহল, বিরাগ-অনুরাগের মায়াজাল, স্নেহ-মমতার সমূহ দীর্ঘশ্বাস। নামটি শুনলেই তাবৎ দুনিয়ার চোখগুলো হয়ে যায় আবেগভরা আটলান্টিক। যাদের মা নেই-তারা যেন মধ্যাহ্ন দিবাকরের সামনে জন্মান্ধ। যেই মা তার প্রিয় সন্তানকে কোলে-পিঠে মানুষ করে বড় করেছেন, সেই মা আবার সেই সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা করে- এ কেমন সভ্য সমাজের বীভৎস দৃশ্য ! যেই মা ৯ মাস ১০ দিন আগলিয়ে রেখেছিল যে সন্তান-জঠর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, পৃথিবীর আকাশ তখন গভীর ফ্যাকাশে- সেই সন্তানকে নিমিষেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিল মা নামের সেই পাষণ্ড নারী। গর্ভধারিণী এক মা নিজ হাতে আগুনে পুড়িয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করল ফটিকছড়ি সদর এলাকায়। সেই পাষণ্ড মায়ের দেয়া আগুনে ১৩ দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে গত ৩১ অক্টোবর শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেলের বার্ণ ইউনিটে মারা গেছে ১১ বছরের কিশোরী বিবি খাইরুন্নেছা। আর কিশোরীকে দেখাশোনা করতে গিয়ে তার আপন চাচা মোহাম্মদ সোলায়মান ২৬ অক্টোবর ঢাকায় পিকআপের ধাক্কায় মারা যায়। দু’টি ঘটনা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। দু’টি ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ফটিকছড়িসহ চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়। পারভীন আক্তার নামের সেই পাষন্ড নারী, মা নামের কলঙ্ক গত ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬ টার দিকে তার কিশোরী মেয়ে বিবি খাইরুন্নেছার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পারভীন ফটিকছড়ি পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের রুস্তম খাঁ চৌধুরী বাড়ির মরহুম কবির আহমদের ছেলে কুয়েত প্রবাসী মোহাম্মদ লোকমানের স্ত্রী। এ সময় কিশোরীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা এসে তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসকরা কিশোরীর শরীর ৭০ ভাগ পুড়ে যাওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে প্রেরণ করেন। সেখানে ৩১ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিশোরীটি মারা যায়। এমনও মা হতে পারে-এটা যেন কল্পনার বাইরে। ‘আমি মানুষকে (তাদের) পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি, তার মা কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে এবং দুই বছর পর সে (সন্তান) বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছে, তুমি (তোমার নিজের সৃষ্টির জন্যে) আমার শোকর আদায় করো এবং তোমার (লালন পালনের জন্যে) পিতা-মাতারও কৃতজ্ঞতা আদায় করো, (পরিশেষে তোমাদের) আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে’-সূরা লোকমান-১৪। কোরআনের এই আয়াতকে বুকে ধারণ করে পৃথিবীর সব মা যদি তাঁদের সংসার জীবন চালাতে পারতেন তাহলে সন্তানের উপর এই নির্মম নির্যাতনের ঘটনা ঘটত না। পৃথিবীর জমিন যেন কাঁপছে, আকাশ যেন বিদীর্ণ হচ্ছে। নিজ গর্ভের সন্তানকে এভাবে পুড়িয়ে হত্যা-হতবাক করেছে সারা দেশের মানুষকে। প্রতিবাদের ভাষা যেন খুঁজে পায় না তারা।
যে সন্তান তার মাতা পিতার জন্য এভাবে দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ শৈশবকালে যেমনি মা-বাবা আমাদেরকে লালন পালন করেছেন তেমনিভাবে আমারও যেন এ বার্ধক্য অবস্থায় তাঁদের সেবা-যত্ন করতে পারি’- এই দোয়াটি করার সেই সুযোগটি দিল না মা নামের সেই পাষন্ড নারী। হতে পারত সেই মেয়েটি হযরত সুমাইয়া (রা.) এর মতন ঈমানী চেতনায় তেজোদীপ্ত একজন বীরাঙ্গনা মহিলা, আল্লাহর রাহে জীবন দেয়া ইসলামের প্রথম শহীদ। হতে পারত হযরত খাদিজাতুল কোবরা (রা.) এর মতন বিদূষী মহিলা-ইসলাম গ্রহণ করা প্রথম ব্যক্তি। হতে পারত হযরত মা ফাতেমা (রা.) এর মতন- যাঁর মর্যাদা জান্নাতের সর্দারণী। শিশু-যুবা-বৃদ্ধ কাঁদে, পাখিকূল কাঁদে, সবুজে সবুজে মোড়ানো তেপান্তর কাঁদে। আমরা যেন আবারো আবেগে আপ্লুত হই এ ঘটনায়। আরো বেশি জমানো আদরগুলো বিলিয়ে দিই নিজস্ব সন্তানের অকৃত্রিম চাহনিতে। স্নেহ-মমতার আঁকি বুঁকি করি নিশিদিন। মমতার চাদরে ঢেকে রাখি আদরের সন্তানগুলো। কোরআনের শিক্ষায় আলোকিত করে দিই পুরোদিনের রোজনামচা, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। শান্তির জোৎস্নায় নির্মাণ করি আল্‌-কোরআনের জীবন্ত পৃথিবী।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীতে সাধারণ মানুষের জন্য মানবিক কর্মকাণ্ড
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা