জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

| শুক্রবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:১৬ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রতি ভালোবাসা
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলুন। তাঁর প্রিয় রাসূলের আদর্শ অনুসরণ করুন। তাঁর প্রতি অকৃত্রিম আনুগত্য ও ভালবাসা প্রদর্শন করুন। প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা খোদাপ্রাপ্তির পূর্বশর্ত। ঈমানের পূর্ণতা অর্জন ও আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির অর্জনের লক্ষ্যে প্রিয় নবীকে পৃথিবীর সব কিছুর চাইতে এমনকি নিজের জীবনের চাইতে অধিক ভালবাসুন। নবীজিকে ভালবাসার অর্থ হল জীবনের সব দিক থেকে নবীজির আদর্শ ও জীবন চলার পথ অনুসরণ ও অনুকরণ করা।
রাসূলুল্লাহর প্রতি ভালোবাসা কুরআনের দাবি: ভালোবাসা নাই তো সবকিছুই মূল্যহীন, পৃথিবীতে যা কিছুই দৃশ্যমান সব কিছুই ভালোবাসার অনুপম নিদর্শন। একজন মানুষ সন্তান-সন্ততি পরিবার পরিজনের ভালোবাসায় ধন-সম্পদ, অর্থ বিত্ত, গাড়ি, বাড়ি, শিল্প, বাণিজ্য সবকিছুই নির্মাণ করে ও উৎসর্গ করে। আল্লাহতা’আলা তো সমগ্র সৃষ্টি কুলের স্রষ্টা, তিনি তো সন্তান সন্তুতি হতে পূত:পবিত্র। তিনি একমাত্র তাঁর মাহবুব সমগ্র সৃষ্টিরাজির কেন্দ্র বিন্দু, যার ভালবাসায় তিনি সমস্ত নবী রাসূল ফেরেস্তারাজি, মানব-দানব, আসমান জমীন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আরশ, কুরসী, লওহ, কলম সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (আ.)কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যদি আমার প্রিয় মাহবুব মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না হতেন আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না। (যুরকানী আলাল মাওয়াহীব, খন্ড: ১ম, পৃ: ৬২, তাফসীর রুহুল বায়ান, সূরা: আহযাব, পৃ:২৩০)
মহান আল্লাহ তা’আলা পিতা-মাতা, ছেলে-সন্তান, ধন-সম্পদকে ভালবাসতে নিষেধ করেনি তবে সব কিছুর চাইতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অধিক ভালোবাসতে হবে। নবীজির প্রতি সর্বোচ্চ ভালোবাসা না থাকলে আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়া যাবেনা। মহান আল্লাহতা’আলা তাঁর প্রিয় রসূলের প্রতি ভালোবাসাকে তাঁর প্রতি ভালোবাসার পূর্বশর্ত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে মাহবুব আপনি বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ পাকও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুণাহসমূহ মার্জন করবেন। (সূরা: আলে ইমরান: ৩১)
নবীজির প্রতি ভালোবাসা ছাড়া ঈমান পরিপূর্ণ হবেনা: সন্তান সন্তুতির কাছে নিজ পিতা-মাতার সম্মান মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। আদর্শবান সন্তান-সন্তুতি পিতা-মাতার সুখ-শান্তি, সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর চাইতে আরো কোটিগুণ অধিক ভালোবাসতে হবে। নবীজির প্রতি ভালোবাসার প্রশ্নে প্রয়োজনে সবকিছু ত্যাগ করতে হবে। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন সে সত্তার শপথ। যার কুদরতী হস্তে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবেনা যতক্ষণ না আমি তাঁর নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি থেকে অধিক প্রিয় হব। (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ১৪)
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তোমাদের কেউই ততক্ষণ ঈমানদার হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, সন্তান ও সকল মানুষ হতে প্রিয় না হই। (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ১৫, মিশকাত শরীফ, পৃ: ১২)
নবীজির প্রতি ভালোবাসা কিয়ামতের সম্বল: নবী প্রেমিক মুসলমানরা পরকালে নবীজির নূরানী সান্নিধ্য লাভে ধন্য হবে। তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হবে। এরশাদ হয়েছে, “সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে আরজ করলেন হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামত কবে হবে? নবীজি বললেন, তুমি কিয়ামতের জন্য কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ? সাহাবী বললেন, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসি। নবীজি বললেন তুমি যাকে ভালোবাস তাঁর সাথেই তুমি থাকবে। হযরত আনাস (রা.) বললেন ইসলাম গ্রহণের পর আমরা এতো আনন্দিত আর কখনো হইনি যতটা নবীজির এ কথায় আনন্দিত হয়েছি। নিশ্চয়ই তুমি তার সাথেই থাকবে, যাকে তুমি ভালোবাস। হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হযরত আবু বকর ও হযরত ওমর (রাদ্বিয়া আল্লাহ তা’আলা আনহুমা) কে ভালোবাসি, আমি আশাবাদী তাঁদের সাথেই থাকব। যদিও আমি তাদের অনুরূপ আমল করতে পারিনি। (বোখারী শরীফ, খন্ড:১ম, পৃ: ৫২১, হাদীস নং : ৭১৫৩)
নবীজির প্রতি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ভালবাসা: হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ছিলেন অদ্বিতীয় আশেকে রাসূল সাহাবী। নবীজির প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ভালবাসাই ছিলো তাঁর জীবনের সাধনা। তিনি বলেন, পৃথিবীর তিনটি জিনিষ আমার কাছে অধিক প্রিয়। এক: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরানী চেহারা মুবারকের প্রতি দৃষ্টিপাত করা, দুই: আমার সমুদয় সম্পদ প্রিয় রাসূলের খিদমতে উৎসর্গ করা। তিন: আমার প্রিয় কন্যা আয়েশা সিদ্দিকা নবীজির সহধর্মিণী হিসেবে থাকা। (আনোয়ারুল বায়ান: ২য় খন্ড, পৃ: ১৬৬)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবীজির পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত: মাহবুবে মুস্তফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) অন্তিমকালে ওসীয়ত করেছিলেন, ইন্তেকালের পর আমার খাটিয়া রওজায়ে রাসূলের সামনে নিয়ে যাবে। নবীজির সমীপে সবিনয় আরজ করবে আপনার প্রিয়তম সঙ্গী আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে আপনার সমীপে হাজির করা হলো, রওজায়ে আকদাসের কপাট যদি এমনিতেই খুলে যায়। প্রিয় রাসূলের পাশেই দাফন করবে। অন্যথায় জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে দাফন করবে। ওসীয়ত মোতাবেক ইন্তেকালের পর রওজায়ে আকদাসের সামনে খাটিয়া পেশ করা হলো, নবীজির সমীপে দাফনের অনুমতি আবেদন করা হলে রওজা মোবারক থেকে নূরানী আওয়াজ ভেসে আসলে। বন্ধুকে বন্ধুর সাথে মিলন করিয়ে দাও, বন্ধু বন্ধুর সাথে মিলনের অপেক্ষায়। (তাফসীর কবীর, খন্ড: ৫ম, পৃ: ৪৬৫, খাসায়েসে কুবরা, খন্ড: ০২, পৃ: ২৮১)
ভালবাসার নিদর্শন: মৌখিক দাবীর নাম ভালোবাসা নয়, রাসূলুল্লাহর প্রতি উম্মতের ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। নিজের কথায়, কর্মে, আচরণে, ব্যবহারে, চলনে-বলনে, শিক্ষায়-দীক্ষায়, সততায়-নিষ্ঠায়, মানবতা, উদারতা, সেবা, সম্প্রীতি ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলীর প্রকাশ ও বিকাশে নবীজির জীবনাদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে নবীজির প্রতি প্রকৃত আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রমাণ করতে হবে। তখনই হবে ভালোবাসার সার্থকতা ও বাস্তবতা। হযরত ইমাম কাযী আয়ায (র.) ভালোবাসা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, নবীজিকে ভালোবাসার নিদর্শন হলো কুরআনকে ভালোবাসা অর্থ হচ্ছে কুরআনের প্রতি ভালোবাসার মর্ম হচ্ছে প্রত্যহ কুরআন তিলাওয়াত করা, কুরআনের বিধি-বিধান অনুসারে আমল করা, কুরআনের অর্থ বুঝা, অনুধাবন করা, কুরআনের নির্দেশিত কর্মপন্থা নিয়ম পদ্ধতি ভালোবাসা ও পছন্দ করা। কুরআনের বিধান লঙ্ঘন না করা। কুরআনকে মহব্বত করা মানে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহব্বত করা। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, “যে কেউ কোন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে চায় কুরআন থেকে অনুসন্ধান করবে। যদি সে কুরআনকে মহব্বত করে প্রকৃত পক্ষে সে আল্লাহ ও তদীয় রাসূলকে মহব্বত করে। (তাবরানী, মুজামুল কবীর, শিফা শরীফ, ২য় খন্ড)
নবীজির প্রতি হযরত ফারুকে আজমের ভালোবাসা: মুসলমান নামধারী বিশর নামে এক মুনাফিক ছিল এক ইয়াহুদীর সাথে তাঁর ঝগড়া হল, ইয়াহুদী প্রস্তাব করল বিবাদ মিমাংসার জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করা হোক। বিচার মিমাংসার জন্য তারা নবীজির খিদমতে উপস্থিত হলো, ঘটনা অনুসন্ধানের পর ইয়াহুদীর হক প্রমাণিত হওয়ায় নবীজি ইয়াহুদীর পক্ষে রায় দিলেন, মুনাফিক লোকটি যে বাহ্যিক ভাবে মুসলমান সেজেছে সে বের হয়ে মন্তব্য করলো মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর ফায়সালা সঠিক হয়নি। হযরত ওমর ফারুক আজম (রা.)’র কাছে পেশ করা হোক, তিনি যেটা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটা মেনে নেয়া হবে। উভয়ে হযরত ফারুকে আজমের নিকট গেলেন। ইয়াহুদী ফারুকে আজমের সম্মুখে বিস্তারিত ঘটনা বর্ণনা করলেন, তিনি ঘটনা শুনে বললেন একটু অপেক্ষা করুন। আমি এক্ষুণি ভেতর থেকে আসছি এবং চূড়ান্ত ভাবে ফায়সালা করবো। তিনি ঘরের ভেতরে গিয়ে ধারালো তরবারী নিয়ে এলেন ক্ষুরধার তরবারী দিয়ে মুনাফিকের শিরশ্ছেদ করে দিলেন এবং ঘোষণা দিলেন, যে ব্যক্তি আমার প্রিয় রাসূল আক্বা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফায়সালা মানবে না তার ফায়সালা আমার তরবারী চূড়ান্ত করবে। (তাফসীর কবীর, খন্ড:৩, পৃ: ২৪৮, তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১২২)
হযরত ওসমান (রা.)’র ভালোবাসা: ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় মক্কার কাফিরদের সাথে আলোচনার জন্য প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওসমান (রা.)কে দূত হিসেবে মক্কায় প্রেরণ করেন কুরাইশরা বললো, তোমাদের নবী মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ জন্য খানায়ে কাবা তাওয়াফ করার অনুমতি নেই। তুমি যখন এসেছো তোমার জন্য খানায়ে কাবা তাওয়াফের অনুমতি দেয়া হলো। তিনি তাওয়াফ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, অসম্ভব আমি ততক্ষণ পর্যন্ত তাওয়াফ করতে পারি না যতক্ষণ না আমাদের নবী রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফ করেন। (শিফা শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ:৩২, মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৬১)
নবীজির প্রতি হযরত আলী (রা.)’র ভালোবাসা: আমিরুল মুমেনীন হযরত শেরে খোদা মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কে জিজ্ঞেস করা হলো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কিরূপ ছিল? তিনি জবাব দিলেন আল্লাহর শপথ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নিকট আমাদের ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্তুতি, পিতা-মাতার চেয়েও অধিক প্রিয়। এমনকি তীব্র পিপাসার সময় কোমল পানীয় অপেক্ষাও অধিক প্রিয় ছিলেন। (শিফা শরীফ, খন্ড: ২য়, পৃ:৮১, মাদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:১ম, পৃ: ৩৪৮)
হে আল্লাহ আমাদের আপনার ভালোবাসা ও আপনার প্রিয় মাহবুব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অকৃত্রিম ভালোবাসা দান করুন, জীবনের সর্বক্ষেত্রে নবীজির আনুগত্য ও কুরআনের বরকত নসীব করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা পরিত্রাণ নসীব করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসভ্য সমাজের এ কেমন বীভৎস দৃশ্য!
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃতিই পৃথিবীর ফুসফুস