কথাসাহিত্যিক তাপস মজুমদারের ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’ মনের ভেতরে কৌণিক আলো ফেলা অনুপম একটি গ্রন্থ। এটি জীবনের গভীর উপলব্ধিমূলক, স্মৃতিচারণ, দুঃখবোধ–যাতনা এবং আত্মোপলদ্ধির নানারকম চিন্তা চেতনা ও বোধের জন্ম দেয়। মনের ভেতরকার চকলেট রঙা স্পটকে উলটপালট করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের জীবন সমীকরণের সমস্ত ব্যাপ্তি তছনছ করে দেয় এই গ্রন্থের আলোচনার বিষয়সমূহ। তৎসময়ের জীবনের গভীর তলের কথা টেনে আনে এর ভাব বর্ণনার পাঠ আবেগাপ্লোত করে। ৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্য আমার শৈশব জীবনের চিন্তা প্রবাহকে কিঞ্চিৎ রেখাপাত করে। সমস্যার গভীরে অনুসন্ধান করতে না পারলেও পাকিস্তানি যুদ্ধবাজ নিপীড়কদের নির্মম অত্যাচার আর মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্বান্ত হওয়া আমার পরিবারের ক্ষোভ ও ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ আবছা আবছা মনে আছে। মনে পরে শ্রান্ত, শুষ্ক, ভগ্নবুকে আশার ধ্বনি তোলে ধারকর্জ করে নতুনভাবে জীবন শুরু করার মর্মান্তিক ঘটনা। এই গ্রন্থ পুনর্বার মনে করিয়ে দেয় এইসব দুর্বিসহ জীবনকাহিনি।
যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার মুখোমুখি হয়ে সমগ্র জাতি পাকিস্তানের দাসত্বশৃঙ্খল ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে, তা ইতিহাসের পরতে পরতে লেখা হবে অনাদিকাল ধরে। এই গ্রন্থও এক কিশোরের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ এবং গভীর ক্ষত বুকে নিয়ে পরবর্তীকালে চলমান জীবনের কিছু খণ্ড খণ্ড স্মৃতি–ওরাল হিস্ট্রি। লেখক তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকার কথা। বই খাতা রাবার পেন্সিল নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দেশ স্বাধীন করার অনিবার্য পরিণতিতে বর্বর পাকিস্তানী জান্তাদের নৃশংস অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের করাল ছায়া আড়াল করতে পরিবারের সবার সঙ্গে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে। প্রাণ রক্ষার তাগিদে শরণার্থী জীবনের অবর্ণনীয় কষ্ট স্বচক্ষে দেখেছেন। শুনেছেন–মুক্তিযুদ্ধ গলার কাঁটা হয়ে বিধতে থাকা অসংখ্য অত্যাচারের দুর্বিষহ বিরল মূহূর্তের কথা।
স্বাধীনতা পূর্বকালে মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপনকারীরা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কান্না মেশানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবন চলমান রেখেছে। লাঞ্চিত–নিপীড়িত–বঞ্চিত–নিঃস্ব হওয়া অজস্র কাহিনির মধ্যে একান্তই নিজস্ব কিছু কাহিনি রসঘন করে ফুটিয়ে তুলেছেন স্মৃতিগদ্যের এই গ্রন্থে। ইতিহাসের পরিত্যাক্ত পুঁথি পড়ে নয়। নিজের জীবনের স্মৃতি হাতড়ে এই বইতে হাজির করেছেন লেখকের কৈশোরকালে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে জমে থাকা পরম উপাদেয় সব জীবনকাহিনি।
হয়তো সেইদিন আর ফিরে আসবে না। কিন্তু কষ্টকর সেইসব গল্পনদীর তীরে দাঁড়িয়েছিলেন দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। কিশোরবেলার দুঃসহ যাপন ও কালাতিপাতের গভীরে ঢুকে লিখেছেন বড় বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ।
দীর্ঘসময় নেকাব–মুখোশ–মাস্কের আড়ালে থাকা এক কালখণ্ডের ইতিহাস, পাঠ তৃপ্তিরসাহিত্যগুণে লিপিবদ্ধ করেছেন। রক্তস্রোতের ভেলায় ভাসতে ভাসতে লেখক দীন হীন দুর্বল অশক্ত হয়ে পড়েননি। তিনি দাপুটে কিছু অনুপম শব্দ চয়নের মাধ্যমে নিতান্ত এক আন্তরিক তাগিদে মুক্তিযুদ্ধকালীন কৌতুহলী অভিজ্ঞতাকে এই বইয়ে লিপিবদ্ধ করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি লিখেছেন-‘প্রাথমিকের চতুর্থ শ্রেণি পেরিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা শান্ত নিবিড় গ্রামীণ জীবনের আকস্মিক শেকড় ছেঁড়া এক কিশোরের নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধের নির্মম সামাজিক ঘটনাবলী এ লেখার প্রেক্ষাপট’।
লেখকের জীবন্ত বর্ণনায় আবারো প্রমাণ হয় একজন মানুষের জীবন একটি মহাকাব্য। একটি বিশাল উপন্যাস, কিংবা অসংখ্য ছোট ছোট গল্পের সমাহার। ঠিক তেমনি ভিন্ন ভিন্ন ৩৬ টি গদ্যে নিজের জীবনস্মৃতি পরম নিষ্ঠায় সাজিয়েছেন। অকপট স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে অনেক গূঢ় ইতিহাস ব্যক্ত করেছেন। সেই সময়ের পরিবেশ– প্রকৃতি–অর্থনীতিও ফুটে ওঠেছে প্রাঞ্চল বর্ণনায়। মুখবন্ধ চোখ বুলিয়ে বিচ্ছেদ বেদনার সুরে লেখা মা দিবস পড়তে শুরু করলে কৌতুহল ক্রমশ বাড়তে থাকে। নিজের জীবনগল্পের সাথে হুবহু মিল খুঁজে পাই। অন্তঃমিল। বিশেষ করে শরণার্থী জীবন থেকে শুরু করে পরবর্তী দশকের নানা টানাপোড়নের বিচিত্র পরিক্রমা। ‘ফিরে চল মাটির টান থেকে’, ‘অন্তর করিছে অন্ধনয়নে অশ্রু বরিষণ’ এই বরিষণ আমাকে বিশেষভাবে স্মৃতিকাতর করেছে। লেখক যেমন লিখেছেন ‘গোটা বাড়ি পুড়বে কী করে? ৩০ ইঞ্চি মোটা মাটির দেয়াল, পুরু করোগেটেড টিনের চাল, পাকা তাল গাছের মজবুত খুঁটি’। আমাদেরও এর কাছাকাছি ছিল। খুব অল্প বয়স হলেও কেমন করে জানি স্পষ্ট মনে আছে ছবির মতো সুন্দর আমার গ্রামের বাপ দাদার ভিটেমাটির নিশ্চিহ্ন বসতবাড়িতে বাবার হাত ধরে গভীর রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা পৌঁছেছিলাম। বিরান ভূমি। আমাদের বাড়িতে আগুনসন্ত্রাস না হলেও ঘরদোর–পালাখিলা, দরজা–জানালা খিরকি–বেড়া সবই উধাও।
সামনাসামনি দেখা, উপলব্ধি করা এবং নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে ‘শাবাস বাংলাদেশ’ গড়ে ওঠার স্মৃতি নিয়ে আমাদের বেড়ে ওঠা। আবেগতাড়িত হওয়া ‘কাহিনি যুদ্ধের নয় জীবনের’ গ্রন্থ আমাকে নতুন করে জীবন ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে। এই বইয়ের লেখার মাঝে কবিত্ব স্বভাব উঁকি দেওয়া লেখক তাপস মজুমদারের আকাঙ্ক্ষা পরবর্তী জীবন সংগ্রামের কথা তুলে ধরা। আমরাও অপেক্ষায়। সংযোজিত হবে সাহিত্যজগতে নতুন অধ্যায়।
আশা করি যুদ্ধপরবর্তী প্রজন্ম এই বই থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎসময়ের জীবনজিজ্ঞাসার সম্যক ধারণা পাবে। লেখক–প্রকাশক–পরিবেশকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী