বে-ওয়ানে আতংকের ১২ ঘণ্টা

কূলে ফিরে স্বস্তিতে পাঁচ শতাধিক যাত্রী ।। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের কমিটি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং আতংকের মধ্যে ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়ে আলোচিত ক্রুজিং ভ্যাসেল বে-ওয়ান অবশেষে কূলে পৌঁছেছে। সাবেক মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী শিল্পপতিসহ পাঁচ শতাধিক পর্যটক স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলেছেন। নির্ঘুম রাত এবং দিনের বেশিরভাগ সময় চরম উদ্বেগের মধ্যে কাটানো যাত্রীরা গতকাল দুপুর ১টা নাগাদ পতেঙ্গা ওয়াটার বাস টার্মিনালে নেমে স্বজনদের জড়িয়ে ধরেন। এ সময় অনেককেই কান্না করতে দেখা যায়। জাহাজটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বিকেএমইএর পরিচালক এবং বে ওয়ান জাহাজের যাত্রী মীর্জা আকবর আলী চৌধুরী গতকাল জাহাজ থেকে নামার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, মৃত্যুর আতংক মাথায় নিয়ে এক একটি ক্ষণ কাটানো কী যে কষ্টের তা কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে জাহাজটিতে চড়েছিলাম। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আগুন জ্বলে উঠবে। এই বুঝি জাহাজ বিস্ফোরিত হবে, এই বুঝি সাগরে ঝাঁপ দিতে বলা হবে। লাইফ জ্যাকেট পরানোর পর স্বজনদের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সাবেক প্রধান ডা. শংকর ঘোষ বলেন, এক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করতে পারিনি। সারাক্ষণই তাড়া করেছে আতংক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাহাজটি সম্পর্কে যে সব নেতিবাচক প্রচারণা চলছিল তাতে আতংক আরো বাড়ছিল। জাহাজটি নাকি বহু বছরের পুরনো। সত্যি জাহাজটি পুরানো কিনা, এত পুরনো জাহাজ কী করে চলছে সেগুলো তদন্ত হওয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এত মানুষের জীবন নিয়ে সত্যি চিনিমিনি খেলা হচ্ছে কিনা তা তদন্ত করা দরকার। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পতেঙ্গা থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া জাহাজটি সাগরের মাঝ বরাবর যাওয়ার পর রাত ১টা নাগাদ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রথমে কাউকে ব্যাপারটি বুঝতে দেয়া হয়নি। যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন যে, জাহাজ কর্তৃপক্ষ ইঞ্জিনের সমস্যা, ধোঁয়া, আগুনের খবর ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড বা দায়িত্বশীলদের জানায়নি। যাত্রীরাই আতংকিত হয়ে স্বজনদের ফোন করে দুর্ভোগের কথা জানান। অনেকেই ফেসবুক লাইভ করে দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন। অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষিতে ক্রুরা আতঙ্কিত যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট পরানোর ব্যবস্থা করেন। পুরো জাহাজে আতংক চরম আকার ধারণ করে। ওই সময় জাহাজে কান্নার রোল ওঠে। অনেকেই প্রার্থনা করতে থাকেন। দোয়া-দরুদ পড়েন। গভীর সাগরে থাকায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যাও প্রকট হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন নিভাতে গিয়ে এবং হুড়োহুড়ি করে বেশ কয়েকজন কমবেশী আহত হন। রাত ২টায় জাহাজের আগুন নিয়ন্ত্রণে বলে ক্রুদের পক্ষ থেকে জানানো হলেও আতংক কমেনি। ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়া জাহাজটি মাঝ সাগরে আটকা পড়ে। রাতে জাহাজটিকে সেন্টমার্টিনের দিকে নাকি পতেঙ্গার দিকে টেনে নেয়া হবে তা নিয়ে যাত্রীদের সাথে বাকবিতন্ডা হয়। পরে বৃহস্পতিবার রাতভর সাগরে থাকার পর গতকাল শুক্রবার সকাল দশটা নাগাদ জাহাজটি উদ্ধারে অভিযান শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শক্তিশালী টাগ বোট কান্ডারী-১০। বেলা ১ টা নাগাদ জাহাজটি পতেঙ্গা ওয়াটার বাস টার্মিনালে পৌঁছে।
কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের একজন কর্মকর্তা জানান, জাহাজটি নিরাপদে ওয়াটার বাস টার্মিনালে পৌঁছেছে। জাহাজটির একটি ইঞ্জিনে এয়ার লক হয়েছে। আরেকটি ইঞ্জিন সচল আছে। জাহাজটি ঠিকঠাক করে আবারো চালানো হবে। বৃহস্পতিবারের যাত্রীদের টিকেটের অর্থ ফিরিয়ে দেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
পিও (এমএমডি) কাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ জাহাজটির চলাচলের অনুমোদন আছে কিনা সে প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে বলেন, বিষয়টি ডিজি শিপিং দেখেন। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত কিনা সেটা আমরা পরীক্ষা করি। গত বছর নভেম্বর মাসের পরীক্ষার রিপোর্টে জাহাজটি চলাচলের উপযুক্ত পাওয়া গেছে। এখন অগ্নিকাণ্ডের পর আবার কমিটি করে দিয়েছি; তিন সদস্যের কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
জাহাজটির চলাচলের অনুমোদন আছে কিনা এ বিষয়ে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিষয়টি জানতে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্সের মালিক এম এ রশিদকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।
একাধিক নির্ভরশীল সূত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা ৩০ বছরের পুরনো জাহাজটির লাইফটাইম ও চলাচলের অনুমোদন নেই বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযেতে হবে সীমান্তে, কিন্তু কীভাবে
পরবর্তী নিবন্ধসীমান্তবর্তী দেশগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশিদের ইউক্রেন থেকে সরিয়ে নেয়া হবে