হারুনর রশীদ সাহেবকে চট করে কেউ চিনতে না পারলেও উনার পরিচালিত ছবি ‘মেঘের অনেক রঙ’ এর নাম প্রায় সকলের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে হাতে গোনা যে কয়েকটি সেরা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ‘মেঘের অনেক রঙ’ সেগুলির অন্যতম। ‘মেঘের অনেক রঙ’ বাংলাদেশের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। যদিও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত রঙিন ছবি আকবর কবির মিন্টু পরিচালিত ‘বাদশা (১৯৭৫)। ‘মেঘের অনেক রঙ’ মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। নানা কারণে এ–ছবি বাংলাদেশে কিংবদন্তি মর্যাদা পেয়ে গেছে।
হারুনর রশীদ এরপর বেশ কয়েকটি মূলধারার ছবি (রঙিন গুনাইবিবি, ভাগ্যবতী, ধনবান, অসতী) নির্মাণ করেছেন এবং সেসব ছবি জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও মেঘের অনেক রঙ (১৯৭৬) তাঁকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।
হারুনর রশীদ ছিলেন অত্যন্ত অন্তর্মুখী একজন মানুষ। বহুগুণের অধিকারী এই শিল্পীর মধ্যে কোনো জাহিরিসানা দেখিনি কোনোদিন যা আজকাল আমাদের প্রধান ভূষণ। একাধারে তিনি ছিলেন গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা এবং সর্বোপরি একজন চলচ্চিত্রকার। আপাদমস্তক চলচ্চিত্র–প্রেমী মানুষটিকে তাঁর অন্যান্য গুণ বা পরিচয়ের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতেন। অথচ অত্যন্ত চমৎকার ছোটগল্প লিখতেন তিনি। ছোটগল্পকার হারুনর রশীদের আলাদা পরিচয় রয়েছে। চলচ্চিত্র সংসদ চর্চার সঙ্গেও সক্রিয় ছিলেন। তবে এক্ষেত্রেও নেপথ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। আমার সঙ্গে তাঁর সংযোগ সে–সূত্রে। ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের ডেলিগেট হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলাম। হারুনর রশীদ সাহেবও একজন ডেলিগেট ছিলেন। উপর থেকে দেখতে বেশ রাশভারী মনে হওয়ায় প্রথম দিকে তাঁর কাছাকাছি যাবার সাহস করিনি। ব্যাপারটি আঁচ করে তিনি পরের দিন থেকে রীতিমত হাসিঠাট্টা শুরু করে আপন করে নিয়ে হারুন স্যার থেকে হারুন ভাই হয়ে গিয়েছিলেন। কোন ছবি দেখবো, কাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলবো এসব তিনি দেখিয়ে দিতেন। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। উৎসবে আগত এঁদের অনেকের সঙ্গে তিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। ছবি দেখার পর ছবিটি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলতেন। কলকাতায় পশ্চিম বঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র নন্দনের আশেপাশে বেশ কিছু দামী রেস্তোঁরা রয়েছে। আমরা সবাই সেসব রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। হারুন ভাই আর তাঁর চিত্রগ্রাহক পংকজদা (পংকজ পালিত) কে সেখানে না দেখে দিন দুয়েক পরে জানতে চেয়ে মৃদু বকুনি খেলাম হারুন ভাইয়ের কাছে। বলেছিলেন, এত বিলাসিতা করলে সংস্কৃতি চর্চা হয় না। দামি রেস্তেরাঁর পরিবর্তে উনারা সস্তার ঝুপড়ি হোটেলে খান এবং টাকা বাঁচিয়ে উৎসবের বিভিন্ন বুকস্টল থেকে প্রচুর বইপত্র কেনেন।
আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে কলকাতায় গেলে ঝুপড়ি কিংবা ফুটপাতের হোটেলে মজা করে সকাল দুপুর রাতে খেয়েছি আর ইচ্ছেমতো ঘুরে বেরিয়েছি, বইপত্তর কিনেছি, দামী হোটেলেও থাকিনি। সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং এই জীবন সূত্রটি হারুন ভাইয়ের কাছে শিখেছিলাম এবং পরবর্তী সময়েও লক্ষ্য করেছি, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করতেন অসাধারণ এই মানুষটির যার মধ্যে অহমিকা, আতিশয্যের লেশমাত্রও দেখিনি।
বেশ কিছুদিন ধরে কর্কট রোগে ভুগছিলেন হারুন ভাই। হাসপাতালে ছিলেন। রোগশয্যায়ও কথা হতো মাঝে মধ্যে। শেষ কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে ১০ জানুয়ারি। বলেছিলেন, ‘আমার এখন শেষ অবস্থা’ কথা ছিল দেখতে যাবো। আমার আর যাওয়া হলো না। উনিই চলে গেলেন।
১৯৭৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মেঘের অনেক রঙ’ ছবির কাজ যখন তিনি শুরু করেন, তখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি তৈরির হিড়িক চলছিল। সেই হিড়িক ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করার। আজগুবি ও মনগড়া কাহিনী নিয়ে সেসব ছবি হতো ভায়োলেন্স আর ভালগারিটিকে সম্বল করে। প্যানপেনে প্রেমও ঢুকিয়ে দেয়া হতো জোর করে। গানও থাকতো অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয়ভাবে। এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম চেষ্টা করেন সুভাষ দত্ত। তাঁর ‘অরুনোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ছবির মধ্য দিয়ে। ছবিটি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশু নিয়ে যেখানে এ–সমস্যার সমাধানের একটা সুন্দর ও বাস্তবসম্মত ইঙ্গিত ছিল। তবে বিষয়টিকে আরো বাস্তবসম্মত ও মানবিক করে উপস্থাপন করেন হারুনর রশীদ তাঁর ‘ ‘মেঘের অনেক রঙ’ ছবির মধ্য দিয়ে যেখানে এক বীরাঙ্গনার জীবন সংগ্রাম করে পরাজিত হওয়ার কথা মর্মস্পর্শীভাবে বলা আছে।
যেকোনও যুদ্ধের মতো বাংলাদেশের যুদ্ধেরও নানারকম পটভূমি ও স্তর রয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক যে স্তর সেটি রীতিমতো ভয়াবহ। আমরা কেবল সামরিক ও রাজনৈতিক স্তর এবং তৎসৃষ্টি লাভক্ষতি নিয়ে কথা বলি। কিন্তু সামাজিক যে অপূরণীয় অবক্ষয় সংঘটিত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমরা সেটি নিয়ে কথা বলি না বা চেপে রাখি। হারুনর রশিদ সেই বিষয়টি নিয়ে চরম সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেছিলেন তাঁর ছবিতে ১৯৭৬ সালে। ছবিটি সে সময় চরমভাবে ব্যবসা বিফল হওয়ায় পরবর্তী সিনেমার কাজ করতে তাঁর অনেক সময় লেগে যায়। অনেক পরে ১৯৯০ সালে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক আরেকটি চমৎকার শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে। ‘আমরা তোমাদের ভুলবনা’ ছবিটি এক কিশোরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে নির্মিত যেটি ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের নানা দিককে উপস্থাপন করেছে আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির স্বল্প বাজেটে নির্মিত ছবিটিতে পরিচালক হারুনর রশীদ সীমিত বাজেট ও সীমিত আয়োজনেও অনেক বিস্তৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যা সম্ভব হয়েছে তাঁর সততা ও আন্তরিকতার কারণে। চমৎকার লোকেশন, দৃষ্টিনন্দন চিত্রগ্রহণ (হারুন অর রশিদ) ও অসাধারণ সংগীত (ফেরদৌসী রহমান)। এই ছবির উল্লেখযোগ্যগুণ।
হারুনর রশীদের জন্ম ১৯৪০ সালের ১৫ মার্চ কুষ্টিয়ায়। ১৯৬৩ সালে পরিচালক সালাহউদ্দিনের ‘ধারাপার’ ছবির সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে তাঁর কর্মজীবনের শুরু।
এরপর সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন জহির রায়হান ও বশীর হোসেনের সঙ্গে। এ সময়ে বেশ কিছু ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। তবে পরিচালক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ আরও অনেক পরে। ১৯৭৬ সালে ‘মেঘের অনেক রঙ’ ছবিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর স্বাধীন পথচলার শুরু। প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর সক্ষমতার জানান দিতে পেরেছিলেন, যদিও তা পরে আর তেমন প্রকাশ করার সুযোগ পাননি। কিন্তু একটি মাত্র চলচ্চিত্রের সূত্রে হারুনর রশীদ স্মরণীয়তা পেয়ে গেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনটিতে তাঁর প্রয়াণ এক প্রিয়জনকে হারানোর বেদনার স্মৃতিকে ধরে রাখবে।