সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই একমাত্র নেতা যিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও স্থপতি। বঙ্গবন্ধুই বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থান দিয়ে বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে এ ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শতাধিক ভাষণের অডিও সিডি থেকে বাছাই করা ৬৭টি নির্বাচিত ভাষণের শ্রুতিলিপির সংকলন ‘ওঙ্কারসমগ্র’। সংকলনভুক্ত ভাষণগুলোর ওপর আলোচনা করতে গিয়ে ড. শ্যামল কান্তি দত্তের মূল্যায়ন হলো : ‘বাগ্মী জননেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন সম্মোহন সৃষ্টিকারী ভাষণকার।’ বঙ্গবন্ধু এমন এক কিংবদন্তী, যাঁর স্মৃতিশক্তির প্রখরতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও বাগ্মিতা সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, এ বিষয়ে তিনি সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
বঙ্গবন্ধুর বাগ্মিতার প্রশংসা বিশ্বব্যাপী। তাঁর বক্তব্য সম্পর্কে ১৯৭০ সালের ৯ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশেষ এক প্রতিবেদনে একজন কূটনীতিকের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এমনকি আপনি যদি তাঁর (শেখ মুজিব) সঙ্গে একাকী কথা বলেন মনে হবে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে তিনি ৬০ হাজার মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতা করছেন।’ বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের সব মানবতাবাদী ও শান্তিকামী মানুষের আদর্শ ও চেতনার মূর্ত প্রতীক। তাই বিশ্বের অনেক বরেণ্য ব্যক্তি, গবেষক ও ইতিহাসবিদ মূল্যায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার। ইতিহাসবিদ উলপার্ট মুজিব-ভুট্টোর পাশাপাশি তুলনা করে বলেছিলেন যে, ‘সমগ্র পূর্বাঞ্চলে মুজিবের জনপ্রিয়তা জুলফিকারের পশ্চিমের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। কারণ পূর্বাঞ্চলে ১ কোটি লোক বেশি। তারা সকলেই বাংলায় কথা বলে ও বোঝে। মুজিব বাংলা ভাষণে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাগ্মী।’ অন্যদিকে, বক্তা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে ভুট্টো নিজেই বলেছিলেন,‘শেখ মুজিবুর রহমান সম্মোহনী বাগ্মী ছিলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কৌশল আধিপত্য নিয়ে ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত কোনো বাঙালি নেতা তার সমকক্ষ বা তাকে অতিক্রম করতে পারেননি।’
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন কোথাও বক্তৃতা করতেন তা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো। যার রাজনৈতিক জীবন ছিল বহু বর্ণিল, বর্ণাঢ্য। তাঁর কণ্ঠে ছিল ইন্দ্রজাল; সেই ঐন্দ্রজালিক শক্তিতেই তিনি ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে এক কাতারে সামিল করতে পেরেছিলেন। নির্ভীক ও স্বপ্নের কারিগর বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে নির্মাণ করেছিলেন, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও এর গৌরবদীপ্ত সাফল্যের ইতিহাস। তিনি ছিলেন এক রাজনীতির মহান কবি। যার ভাষণের পংক্তিতে পংক্তিতে ছিল কাব্যিক ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস ও মাত্রাবোধের এক অপূর্ব সম্মিলন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, তাঁর আত্মসম্মানবোধ তাঁর আত্মবিশ্বাসের মতোই ছিল দৃঢ়। তাঁর মতো অকুতোভয় ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে বিরল। সেই সঙ্গে তাঁর ছিল মানুষকে কাছে টেনে নেওয়ার, দেশপ্রেমের আদর্শে তাদের সংগঠিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর বাগ্মিতা ছিল জাদুবিস্তারী, যার উদাহরণ একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণ। আমরা মনে করি, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কেবল বাঙালির নয়, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্যও প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ভাস্বর ওই ভাষণে বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে গেঁথে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে কোটি বাঙালিকে উজ্জীবিত করতে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর কালজয়ী ভাষণগুলোর অন্যতম। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তিকামী জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে ঐ ভাষণ ছিল এক মহামন্ত্র। বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি ভাষণ কীভাবে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তোলে, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তার অনন্য উদাহরণ। ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এ ভাষণকে ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’র মর্যাদা দিয়ে ‘মেমোরি অব দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’এ অন্তর্ভুক্ত করেছে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বিশ্ব ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উপাদানে পরিণত হয়েছে। গবেষকরা বলেন, ৭ মার্চের জনসমাবেশে আঙুল উঁচিয়ে ধরাটা ছিল তাঁর সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রতীক। এই আঙুল একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শরীরী ভাষারও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইতিহাসের পর্যবেক্ষক ব্রিটিশ জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের ৪১টি সেরা ভাষণ সংকলিত করে ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস : দ্য স্পিসেস দ্যাট ইনসপায়ারড হিস্টোরি’ নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থে মর্যাদাপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। জ্যাকব বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের একটি বাক্যকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে গ্রন্থিত করেছেন এভাবে-‘রিমেম্বার অনস উই হ্যাভ শেড ব্লাড, ইউ উইল নট হেজিটেট টু শেড মোর। বাট উই উইল ফ্রি দ্য পিপল অব দিস কান্ট্রি, ইনশাআল্লাহ।’
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই ভাষণ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে একসূত্রে আবদ্ধ করেন।’ ড. মুস্তফা নূরউল ইসলাম বলেছেন, ‘৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর মহাকাব্যিক ভাষণে বাংলার মানুষকে তাঁর কথা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জোরালো ভাষায় ব্যক্ত করে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিলেন।
সাংবাদিক, লেখক, গবেষক সৈয়দ বদরুল আহসান তাঁর এক লেখায় লিখেন, ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে দিল্লিতে বিরতি নেন বঙ্গবন্ধু। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পথে তাকে দেখতে আসেন বিপুলসংখ্যক ভারতীয় জনতা। তাদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন বঙ্গবন্ধু, যার শুরুটা করেছিলেন ইংরেজিতে। সে সময় উপস্থিত জনতা (যাদের বেশিরভাগই অবাঙালি) বাংলায় তার বাগ্মিতা দেখতে উন্মুখ ছিলেন। জনগণের চাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধুকে মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিতে অনুরোধ করেন ইন্দিরা গান্ধী। ফল হলো রাজনীতি, সংগ্রামী দেশ, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে ভারতের অবদান নিয়ে তার অনর্গল বক্তৃতা।
১৯৭২ সালে প্রধান কাণ্ডারি হিসেবে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে সুষ্ঠুভাবে পুনর্গঠন করেছিলেন, তার সেই ঐতিহাসিক ভূমিকা স্মরণ করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সালের প্রথম সপ্তাহে এবং অবশেষে অনবদ্য সংবর্ধনার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশের রাজধানী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন একই বছরের ১০ জানুয়ারি। একজন রাষ্ট্রনায়ক, অবিশ্বাস্য বাগ্মী বঙ্গবন্ধু খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রথমবারের মতো স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই আবেগে বিপুলভাবে অভিভূত হয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ জানুয়ারি দেয়া ভাষণে তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপের কথা বলেন এবং বাংলাদেশের বিজয়ী জনগণের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন।
এরকম বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ভাষণ হৃদয়গ্রাহী, চিন্তা-আশ্রয়ী, শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয়। তাঁর ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যই যেন অত্যন্ত পরিশীলিত ও যুক্তিনির্ভর। বঙ্গবন্ধুকে চেনা যায় তাঁর বক্তৃতায়। তাঁর বক্তৃতা যেন বঙ্গবন্ধুর স্বরূপ।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী