প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম বাংলাদেশ তথা এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর নগরী এবং প্রত্নসম্পদ সমৃদ্ধ এক সুপ্রাচীন জনপদ। বৌদ্ধদের চৈত্যগ্রাম, হিন্দুদের চট্টল, মুসলমানদের শাৎগাঙ বা চাটিগাঁ, আরাকানীদের চিৎ- তৎ- গঙ (Tsit- Tat- Gung), পাঠানদের ফতেহ- আবাদ, মোগলদের ইসলামাবাদ, পর্তুগীজদের চাটিগাম (Xetigam) বা পোর্টো গ্রান্ডো, ইংরেজদের চিটাগং (Chittagon) এবং পরবর্তীকালের চট্টগ্রাম্থ ইতিহাসের অনেক ঘটনা ও অনেক বাঁক পরিবর্তনের অনুঘটক। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর ও চব্বিশ পরগনার চন্দ্র- কেতুগড় বাংলাদেশের ইতিহাসকে খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বে টেনে নিয়ে যায়। পর্যটক Strabo এর বর্ণনা থেকে মনে হয়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকেও চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর ছিল। (চট্টগ্রামের ইতিহাস- আহমদ শরীফ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১, পৃষ্ঠা-১২)। সে হিসেবে চট্টগ্রামের প্রাচীনত্ব কত বিস্তৃত, তা বলা মুশকিল। তবে কিছু বিষয় বিবেচনায় বিদগ্ধজনেরা মনে করেন, চট্টগ্রামের প্রাচীনত্ব তার চাইতেও দূর- প্রসারী।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের দলিল, ্তু পেরিপ্লাস অব দ্য ইরিথ্রিয়ান স্থি এর স্কেচচিত্রে বন্দর শহর চট্টগ্রামের চিহ্ন সুস্পষ্ট। প্রাচীন গ্রন্থ শুক্লষজুর্বেদে গণ্ডকী নদীর পূর্বদিকে বিস্তৃত নীল সাগরের অথৈ জলের উপর দিয়ে চট্টগ্রামের পর্বতমালার শীর্ষদেশ দৃষ্টিগোচর হতো বলে উল্লেখ রয়েছে। চট্টলতত্ত্ববিদ চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববম্মা তত্ত্বনিধির মতে, ্তু বর্তমান বঙ্গদেশ যখন বঙ্গসাগরের অতল জলে নিমজ্জিত ছিল তখনও এই চাটগাঁর অস্তিত্ব ছিল ্তু। (চট্টগ্রামের ইতিহাস- চৌধুরী শ্রী পূর্ণচন্দ্র দেববম্মা। ১৯২০। গতিধারা পুনঃপ্রকাশ ২০০৪। পৃষ্ঠা- ২২) । প্রাচীন গ্রন্হ পাতঞ্জেেল চট্টগ্রাম আর্যাবর্তের পূর্ব সীমায় অবস্থিত বলা হয়, যা পৌরাণিক সূক্ষ্মদেশের অন্তর্গত। আযরা কামরুপ ও রাক্ষেয়াং (পরবর্তীকালের আরাকান) রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানকে সূক্ষ্মদেশ বলতেন। এই সূক্ষ্মদেশ অতি প্রাচীন ; মহাভারতে ভীমসেনের দিগিজ্বয়ের বর্ণনায় এর উল্লেখ রয়েছে। (পূর্বোক্ত। পৃষ্ঠা- ১৫ ও ২২)।
মহাভারতে বর্ণিত কিরাত রাজ্য বা গ্রিক পর্যটকদের উল্লিখিত কিরাদী রাজ্য যে চট্টগ্রাম তাতো ম্যাকক্রিন্ডল ও পার্জিটারের মতো পণ্ডিতরাও স্বীকার করেন।কিংবদন্তি আছে, কর্ণের পুত্র বিকর্ণ একসময় চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন এবং তার রাজধানী ছিল কাঞ্চননগর। তিব্বতীয় বৌদ্ধ ঐতিহাসিক লামা তারানাথের মতে, চন্দ্র রাজ বংশীয় রাজাদের রাজধানী ছিলো চট্টগ্রাম। আরাকানের সিথাং মন্দিরের শিলালিপিতে এই রাজবংশকে দীর্ঘস্থায়ী ও ক্ষমতাশালী রাজবংশ বলে উল্লেখ করা হয়। সম্রাট অশোক যে সুবর্ণভূমির সাথে যোগাযোগ স্হাপন করেন, তা চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী এলাকায় ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। এতো গেল নিকট অতীতের কথা। দূর- অতীত তথা আদিম যুগের বিষয়ে একটু বলি।
ভূ- তাত্ত্বিকদের গবেষণায় দেখা গেছে, গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নবীন পলিমাটিতে গঠিত হলেও চট্টগ্রামসহ বেশ কিছু অঞ্চল গড়ে উঠেছিল দশ লক্ষ বছর আগে ভূ-ভাগ উৎক্ষিপ্ত হওয়ার সময়কাল ্ত প্লায়োস্টনিক যুগে। (বাংলাদেশের প্রত্নবস্তুঃ প্রাচীন যুগ্ত দিলরুবা শারমিন। সময় প্রকাশন, ২০০৫। পৃষ্ঠা- ১৬)। তাছাড়া বলা হয়ে থাকে, হিম যুগের শেষের দিকে যখন ঠাণ্ডার কাঁপুনে দাপটে পুরো ইউরোপসহ পৃথিবী কাঁপছিল, তখনও বাংলাদেশে তটস্থ হওয়ার মতো ঠান্ডা পড়েনি। এজন্য বরফ যুগেও পৃথিবীর নানা এলাকা থেকে মনুষ্যতর প্রাণীরা বাংলাদেশে এসে ভিড় জমিয়েছিল। তারা প্লায়োস্টনিক যুগে গড়ে ওঠা অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক বসতি উপযোগী ভূখণ্ড চট্টগ্রামে যে পদধূলি দেননি তা কি বলা যায়? সঙ্গত কারণেই ধরে নেয়া যায়, প্লায়োস্টনিক যুগে উৎকীর্ণ ভূভাগগুলোর একটি হিসেবে আদিকালে চট্টগ্রামে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। বৃহত্তর চট্টগ্রামের নানা এলাকায় কিছু প্রত্ন নিদর্শনের সন্ধান প্রাপ্তি ্ত এ ধারণাকে আরও সুদৃঢ় করে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় ১৮৮৬ সালে পাওয়া প্রাগৈতিহাসিক যুগের অশ্মীভূত কাঠের ্তু কৃপাণ্থ (এসব কৃপাণের ৪টি লন্ডনের বৃটিশ মিউজিয়ামে, ১টি কলকাতা মিউজিয়ামে এবং ১টি ঢাকা জাতীয় যাদুঘেের সংরক্ষিত আছে), বৃহত্তর চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটির পাহাড়ি এলাকায় ১৯৫৮ সালে মার্কিন নাগরিক ডাইসনের পাওয়া প্রত্ন- প্রস্তর যুগের কুঠার্থ (জাতীয় যাদুঘেের সংরক্ষিত), ফেনির ছাগলনাইয়া এলাকায় ১৯৬৩ সালে আবিষ্কৃত প্রত্ন- প্রস্তর যুগের পাথরের বিবর্তিত ্তু হাত কুঠার্থ( জাতীয় যাদুঘেের সংরক্ষিত), ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কর্মীভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের গবেষক মোঃ শাহিনুজ্জামান কর্তৃক চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ১টি, বাঁশবাড়িয়ায় ১টি, রাঙ্গামাটির সদর উপজেলার নিউ সার্কিট হাউস এলাকায় ৩টি, কাউখালি উপজেলার ঘাগড়া বাজারে ১টি, লংগদু উপজেলার গুলাশাসালি ইউনিয়েেন ২টি ও আদারক ছড়া ইউনিয়েেন ২টি এবং খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার মানিকছড়ি ইউনিয়নে ১টি স্থানে মোট ১১টি পাথর ও জীবাশ্ম কাঠের তৈরী নব্য প্রস্তর যুগের কুঠার, সেল্ট, ছেনি, ছাঁছুনি, সেল্ট কাম ছাঁছুনি, পয়েন্টসহ অন্যান্য হাতিয়ার ; আদিম মানুষের জীবন- সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এসব নিদর্শন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আদিম মানুষের সাথে চট্টগ্রামের কোনো না কোনো যোগসূত্র ছিল। যদিও তারা এতদঞ্চলের ভূমিজ সন্তান না বহিরাগত, তা গবেষণা সাপেক্ষ ব্যাপার।
চট্টগ্রামের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়- নদী ও সমুদ্রের সহাবস্থান, সুপ্রাচীনকাল থেকে সমুদ্রোপকূলে অবস্থিতি, ব্যবসায়িক বিস্তৃতি, শস্যের পর্যাপ্ততা, সমুদ্র পথে সম্পদ সংগ্রহ ও আদান- প্রদান সহজতর হওয়ার কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেকটা আগেভাগেই চট্টগ্রামে বসতি গড়ে ওঠে, যদিও সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা প্রথম দিকের সে বসতিগুলো ছিল জনবিচ্ছিন্ন, বিরান গ্রাম্থ বিশেষ। চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দারা প্রগৈতিহাসিক যুগের গুহামানব নাকি অন্যরা তা আজও নির্ণিত না হলেও চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে – যাদের ধমনিতে অস্ট্রো- এশীয় রক্তের স্রোতধারা ও দক্ষিণ আরবের গোলমাথা বিশিষ্ট Brachycephals জনগোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছিলো; তারাই মূলত অত্র এলাকায় প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। তারা অবশ্য সংখ্যায় একেবারে নগণ্য ছিল। তারা প্রধানত আদি শ্রেণিহীন কমিউন জীবনযাপন করতো।