পৌরকর পুনর্মূল্যায়ন : বিশিষ্টজনদের ভাবনা

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ১৬ জুন, ২০২১ at ৫:৩০ পূর্বাহ্ণ

পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন (রি-অ্যাসেসমেন্ট) কার্যক্রম শুরু করতে চায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এর অংশ হিসেবে ৩ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে দুটো প্রস্তাব দিয়েছে সংস্থাটি। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে, পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নে ২০১৭ সালের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে কর আদায়। অথবা স্থগিতকৃত পুনর্মূল্যায়ন বাতিল করে নতুন করে অ্যাসেসমেন্ট করা।
ভবন মালিকদের শঙ্কা, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে ‘অতিরিক্ত’ কর পরিশোধ করতে হবে তাদের। এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে নানা কারণে তাদের আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। এ অবস্থায় পৌরকরের হার বাড়লে তা হবে আরো অসহনীয়।
এ নিয়ে দৈনিক আজাদীর কথা হয় গত চসিক নির্বাচনে দুই মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ও এম এ মতিন এবং চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আমীর উদ্দিনের সঙ্গে।

ডা. শাহাদাত হোসেন
সাধারণ মানুষের কথা ভেবে হলেও বিরত থাকা উচিত
করোনার প্রভাবে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের কথা ভেবে হলেও ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম থেকে বিরত থাকা উচিত বলে মনে করেন গত চসিক নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি আজাদীকে বলেন, বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্রাইসিস চলছে। ভবন মালিকদের আয়ও তেমন হচ্ছে না। করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রচুর ঘর খালি। বেশিরভাগ লোক গ্রামে চলে গেছেন। ঘরগুলো খালি থাকলে বাড়ির মালিকের আয় কীভাবে হবে? তাই এ অবস্থায় কোনোভাবে গৃহকর পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হবে না। রি-অ্যাসেসমেন্টের মাধ্যমে গৃহকরের পরিমাণ বাড়লে তা হবে মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক বলেন, লকডাউনের কারণে আর্থিক সক্ষমতা কমেছে। সে জায়গায় যদি কর বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় তাহলে মানুষ অবশ্যই প্রতিবাদ করবে। অতীতে যে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এখন তা আরো জোরালো হবে। স্থগিত হওয়া অ্যাসেসমেন্ট তো প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় নিয়ে নতুন করে সিটি মেয়র কেন আগাতে চাচ্ছেন? তার মানে অন্য কোনো ইনকাম সোর্স সৃষ্টিতে মেয়র ব্যর্থ হচ্ছেন বলেই গৃহকরকে বেছে নিয়েছেন। ওনার উচিত ওখান থেকে ফিরে আসা। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও বিরত থাকা প্রয়োজন। আসল কথা হচ্ছে, তাদের জনগণের ভোটের প্রয়োজন হয়নি। তাই জনগণের কথাও চিন্তা করছেন না।
তিনি বলেন, গৃহকর বেড়ে যায় এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে সিটি কর্পোরেশনের উচিত আয়বর্ধক প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে মনোযোগ দেওয়া। শহরের বর্জ্যগুলো কাজে লাগাতে পারে। রিসাইক্লিং করে সার উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে। বাস সার্ভিস চালু করতে পারে। পেট্রোল পাম্প দিতে পারে। তখন আর পৌরকর নিয়ে মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে না।

এম এ মতিন
জনগণের মুখোমুখি হওয়া থেকে বিরত থাকুন
পৌরকর মূল্যায়নে স্থগিত থাকা রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম পুনর্বহাল হলে সিটি মেয়রকে জনগণের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করেন গত চসিক নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী আল্লামা এম এ মতিন। তিনি আজাদীকে বলেন, মানুষ কিন্তু গৃহকর দিতে প্রস্তুত, যদি তা সহনীয় হয়। কিন্তু জোর করে আদায় করার চেষ্টা হলে মানুষ তা মেনে নেবে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই গৃহকরের ব্যাপারে মানুষের অনীহা তৈরি হবে। এতে সিটি কর্পোরেশনের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। মেয়রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। সর্বশেষ আদায়ও হবে না। কাজেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে মেয়র যেন জনগণের মুখোমুখি না হন সেই পরামর্শ থাকবে।
ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব মতিন বলেন, করোনার জন্য কঠিন মুহূর্ত পার করছে মানুষ। দুর্যোগ চলছে। মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, ইনকাম বন্ধ। জীবনযাপন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময়ে রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম শুরু করলে, কর বৃদ্ধি পেলে মানুষের কষ্ট বাড়বে।
তিনি বলেন, যে রি-অ্যাসেসমেন্ট নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল সেটা আবার পুনর্বহাল করার জন্য বর্তমান মেয়র যে উদ্যোগ নিচ্ছেন তা আমরা কোনোভাবেই সমর্থন করতে পারছি না। আমাদের অনুরোধ থাকবে, যে সিদ্ধান্তে মানুষের উপর কষ্ট হয়, জুলুম হয় সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন।

আমীর উদ্দিন
মীমাংসিত বিষয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হলে বুমেরাং হবে
২০১৭ সালের রি-অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম নগরবাসী কেন মেনে নেননি তা অনুধাবন করার জন্য সিটি মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আমীর উদ্দিন। তিনি মনে করেন, ওই সময় সঠিক পদ্ধতিতে পৌরকর মূল্যায়ন না করায় আন্দোলন হয়েছে। মন্ত্রণালায় স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হবে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন রিসার্চের সহযোগী অধ্যাপক আমীর উদ্দিন আজাদীকে বলেন, গৃহকর নিয়ে চট্টগ্রামবাসীকে টানাহেঁচড়া করা ঠিক হবে না। টানা তিন বছর ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে সরকার অসহনীয় গৃহকর নেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করে। এ মীমাংসিত বিষয় নিয়ে মানুষকে যদি আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হয় তাহলে তা বুমেরাং হতে পারে। আন্দোলন করতে গিয়ে করদাতা সুরক্ষা পরিষদের অনেক নেতাকর্মীর জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছিল, নিপীড়ন-নিগ্রহের শিকার হয়েছিল। এর অভিঘাত এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। গৃহকর আন্দোলনের উত্তাপ শহর পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
তিনি বলেন, সারা দেশের মতো করোনার প্রভাবে চট্টগ্রামবাসীর অর্থনৈতিক অবস্থায় ধস নেমেছে। ভাড়া বাসাগুলোয় সুনসান নীরবতা। শহরের অলিতে-গলিতে ‘টু-লেট’ সাইন বোর্ডের ছড়াছড়ি। এ অবস্থায় ভাড়ার ওপর গৃহকর নেওয়ার তোড়জোড় কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। গৃহকর নিয়ে মানুষকে ডিসটার্ব না করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি মেয়র মহোদয় যদি ভুলে যান, তাহলে তা হবে খুবই দুঃখজনক। চট্টগ্রাম হলো বাংলাদেশের সোনার ডিম পাড়া হাঁস। জাতীয় রাজস্বের শতকরা আশি ভাগ চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। মোগলরা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিজয়ের পর কোনো প্রকার করারোপ কেন করেননি তা সরকারকে বোঝানোর দায়িত্ব চট্টগ্রামের অভিভাবক হিসেবে মেয়র মহোদয়ের। তবে চট্টগ্রামবাসী গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিলের মতো গৃহকরও দিতে চায়, তবে তা হতে হবে সহনীয় ও যৌক্তিক।
তিনি বলেন, স্বৈরাচার এরশাদের সময়ে চট্টগ্রাম বিদ্বেষী আমলাদের করা বাড়ি ভাড়ার ওপর গৃহকর আইন সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মো. মনজুর আলম আলম কেন অনুসরণ করেননি এবং বিদায়ী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কেন গণপ্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা বর্তমান মেয়র মহোদয়কে বুঝতে হবে। বাড়িভাড়ার ওপর হোল্ডিং ট্যাক্স পৃথিবীর কোথাও নেই। চট্টগ্রামবাসী এটিকে ‘গলাকাটা হোল্ডিং ট্যাক্স’ নামে অভিহিত করেছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে শুরু আষাঢ়
পরবর্তী নিবন্ধওমানের কাছে হেরে বিশ্বকাপ বাছাই মিশন শেষ বাংলাদেশের