আধুনিককালে এসে সুইফট পাখি মানুষের আধুনিকতার সাথে খাপ খাইয়ে, নানান দালানের কার্নিশে বাসা বানালেও , আদতে সে তার ছোট্ট বাসাটি বানাত পাথুরে পাহাড়ের গায়ে। অর্থাৎ কোন দালান বা পাহাড়ের তুলনায় তার সুস্বাদু বাসাটি আকারে যেমন অকিঞ্চিৎকর ছিল, বেইজিংয়ের পাখির বাসা নামের ন্যাশানাল স্টেডিয়ামটিও মূল চত্বরের তুলনায় এক্কেবারে তেমনি অকিঞ্চিৎকর ধরনের ছোট না হলেও বেশ ছোটই বলতে হয়। তবে যে স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ৮০ হাজার দর্শক, তার উপর যেটিতে প্রয়োজন পড়লে আরো হাজার দশেক দর্শকের স্থান সংকুলান করা সম্ভব অনায়াসে, সেটি কে তো আর ছোট কিছু বলা চলে না । তারপরও সেটিকে ছোটই বলছি এর গোটা এলাকাটির বিশবালত্বের একটা আবছা ছবি আঁকার জন্যেই।
স্টেডিয়াম চত্বরের যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা চারজন তার বা দিকের কোনটায় এ মুহূর্তে অবস্থান এই পাখির বাসার। কংক্রিট নাকি পাথরের তৈরি এই চত্বরটিতে ঢোকার পর, প্রথমেই যা নজর কেড়েছে, তা হল বিশাল এই চত্বরের স্থানে স্থানে চমৎকার ডিজাইনে দাঁড়িয়ে আছে রাতের বেলায় চত্বরটিকে আলোকিত করার জন্য স্থাপন করা অতিকায় স্টিলের ল্যাম্পগুলো। আকৃতিতে ওগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে, কিছু দূর পর পর দাঁড়িয়ে আছে ঠায় বুঝি প্রাগৈতিহাসিক কোন গাছেরা।
হ্যাঁ বড় মোটা কাণ্ডওয়ালা গাছেদের মতোই দেখতে ওগুলোর গোড়াগুলো কংক্রিট ফুঁড়ে উঠে গেছে উপরের দিকে। চোখের আন্দাজে মনে হচ্ছে মেঝে থেকে ১২/১৪/১৫ ফুট উপরে উঠার পর সেই স্টিলের মোটা কাণ্ড থেকে নানান উচ্চতায় নানান দিকে ছড়িয়েছে তার শাখা প্রশাখা। সেই শাখা ও প্রাশাখাগুলোর শেষ মাথায় লাগানো আছে বাতিগুলো। আকৃতিতে ওগুলোকে আদ্যিকালের গাছেদের মতো মনে হলেও, স্টিলের তৈরি এই ল্যাম্প পোস্টগুলো মনে হচ্ছে প্রতীকীভাবে ধারণ করে আছে একদিকে প্রাচীন চায়নার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও গাম্ভীর্য, অন্যদিক আছে তাতে বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি শিল্পোন্নত চায়নার শক্তি ও জৌলুস।
“উহ এখানে এতো বাতাস! আর ঠাণ্ডাও লাগছে খুব। এই মনু, পিকাসো চলো আমরা তাড়াতাড়ি কিছু ছবি তূলি । চল চল ঐ যে ঐ ল্যাম্পপোস্টটার কাছে যাই।” ভাইপোদের দেয়া হেলেনের এই তাড়াতে বোঝা গেল ল্যাম্পপোস্টগুলোর চমৎকারিত্ব নজর কেড়েছে ওরও। দ্রুত ফিরতি হাঁটা দিয়ে, ঐ দুই চায়নামূর্তির কাছে ফিরতেই, প্রচুর চুং চাং এর মধ্য থেকে ইংরেজি নো, গো, আর ফটো এইসব শব্দের সাথে দুজনে মিলিত তাদের দেহভঙ্গিতে যা বলল বলে মনে হল, তার বঙ্গানুবাদ করলে তা দাঁড়ায় এমন যে, টিকিট ছাড়া ভেতরে যাওয়ার নিয়ম নেই। আমাদেরকে শুধু ছবি তোলার জন্য একটু ভেতরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এবং করতে হবে সে কর্ম দ্রুত।
ওদেরকে আশ্বস্ত করার জন্য বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, লি কাগু আর ভাতিজা। ওকে ওকে। নো গো ভেতরে। অনলি ফটো , ওকে। কথার সাথে অবশ্য হাত পাও নাড়ালাম সুপ্রচুর, তাতে পরিষ্কার হাসি দেখা গেল ভাতিজার মুখে।
“কি হয়েছে বাবা?” পেছন থেকে জ্যাকেট ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে এসময় দীপ্র জিজ্ঞেস করতেই, বললাম শোন আমাদের তো টিকিট নাই। আর এখন টিকিট বিক্রিও হচ্ছে না। তারপরও মনে হচ্ছে লি খাঁ এখানকার গার্ডকে পটিয়ে পাটিয়ে আমাদের জন্য এখানে ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছে। তাই খুব বেশী ভেতরে যাওয়া যাবে না । আর খুব বেশিক্ষণও থাকা চলবে না। চল ঝটপট ছবি তুলে দ্রুত বিদায় হওয়া যাক। এ কথা বলেই, আমদের চেয়ে চত্বরের একটু ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা , হেলেন আর অভ্রর দিকে এগুলাম।
অতপর লি খাঁর বদৌলতে পাওয়া এই বিশেষ সুবিধার কোনরূপ অপ বা অতি ব্যবহারের কারণ না হয়ে, অতি দ্রুত বার্ডনেস্ট স্টেডিয়াম, আর স্টেডিয়ামটিকে পাখির চোখে, মানে বার্ডস আই ভিউতে দেখার জন্য চত্বরের এক কোনায় বানানো সুউচ্চ টাওয়ার, আর ঐ যে বলেছিলামএখনাকার প্রাগৈতিহাসিক গাছের আকার আকৃতির ল্যাম্পপোস্ট, সেগুলোকে ব্যাক গ্রাউন্ডে রেখে, পটাপট ছবি তুলে, সবাই নিয়ে পকেট গেইটের ফিরেতই, এক গাল হাসি উপহার পেলাম ছোকরা গাডের্র কাছ থেকে।
উত্তরে সে বুঝুক আর না বুঝুক, তাকে থেংকুর সাথে, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাতিজা বলে লি খাঁর পিছু পিছু গিয়ে সদলবলে গাড়িতে উঠতেই
ঘুম জড়ানো কণ্ঠের প্রশ্ন ভেসে এলো পেছনের সিট থেকে, “এটা কি দেখা যাচ্ছে ? কোথায় এসে থেমেছিলাম ?”
কেন, দেখছো না, ঐ যে দেখা যায় বেইজিং এর অলিম্পিক স্টেডিয়াম বা ন্যাশানাল স্টেডিয়াম, নাম যার বার্ডস নেস্ট ।
“তুমি তো কিছুই বলোনি আমাকে? আমি কি ভাবে জানবো? আমাকে তো নামতেও বলোনি!” একবার ভাবলাম বলি, তুমিই তো বলেছিলে গাড়ী থেকেই নামবে না। এখন আবার বলছো কেন যে তোমাকে বলিনি? সাথে সাথেই মনের ভেতরের অবচেতন জন ধমকে উঠে রক্ষা করলো এই অধমকে। বক্তব্য তার, আরে বেকুব এই পৃথিবীর সকল ভুলই তো হয় স্বামীদের। গাড়লের মতো আবার মুখ খুলো না। চুপচাপ হজম করো। এরই মধ্যে, লি খাঁ এক্সেলেটরে পা রেখে গাড়িকে গতিজড়তায় নিয়ে গিয়ে, বার্ডস নেস্ট চত্বর থেকে বেরোবার উপক্রম করতেই, মিন মিন করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
সামার প্যালেস?
উত্তরে লি খাঁ “ওকে, ওকে” বলতেই বুঝলাম যে নাহ, যদিও শেষ বিকেলে হয়ে গেছে, আর এখান থেকে যে সেই সামার প্যালেস কতদূর তাও তো জানি না, তারপরও হোটেলে না, লি খাঁ নিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামার প্যালেসেই ।
“এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে কেন তোমরা ? বাইরে ঠাণ্ডা কেমন?”
বউয়ের এই প্রশ্নের সুর আর স্বরে পরিষ্কার হল, একটু আগে যে অবেচতনের ডাকে চেতন ফিরে মুখ না খুলে হজম করে নিয়েছিলাম অভিযোগ, তাতে একদিকে যেমন আমার হজমিশক্তির প্রমান দেওয়া গেছে , তেমনি আবহাওয়াও ঘোলাটে হয়নি।
হুম ঠাণ্ডা যতো না আছে মনে হচ্ছে, তারচেয়ে বেশী লাগছিল কারন বাতাস বেড়েছে অনেক । দেখছো না বাইরের ঐ যে ফোলানো নীলসবুজ রাবার দিয়ে বানানো স্টলটা কেমন উল্টে আছে । এই আবহাওয়ার কারনেই নাকি অন্য কোন কারনে জানি না, আজকের মতো এখানকার টিকিট বিক্রি বন্ধ ।
“কেন তোমরা তো দেখলাম ঐদিকে থেকেই এলে। মনে হল তোমরা ভেতরে গিয়েছিলে?”
হ্যাঁ তা গিয়েছিলাম । ওটা হয়েছে আমাদের চালকসাহেবের সৌজন্যে । এখানে এক গার্ড পাওয়া গেছে যে সম্ভবত তার ভাতিজা বা ভাইগ্না। কিম্বা হতে পারে তারা একই গ্রামের। সেই আমাদের একটু সুযোগ করে দিয়েছিল একটু ভেতরে গিয়ে কয়েকটা ছবি তোলার জন্য।
“আচ্ছা বাবা, আমরা কি এখন হোটেলে ফিরছি ?”
না দীপ্র, যাচ্ছি আমরা এখন সামার প্যালেসে। আচ্ছা শোন , তুমি আর অভ্র কি ২০০৮ সালের অলিম্পিকের ওপেনিং দেখেছিলে?
“না , আমরা তো জানতামই না ওটা। তুমিও তো ছিলে না বাসায় ।“ বড় পুত্রের এই কথায় মনে পড়ল , আরে তাইতো ! আমি তো ছিলাম তখন পেশাগত প্রয়োজনে এক বছরের জন্য সিঙ্গাপুরে, যার কারনে বঞ্চিত ছিলাম শিশুপুত্রদের মধুর সঙ্গ থেকে । কথাটা মনে হতেই দরজা জানালা সব আটো করে বন্ধ থাকার পরও বাইরের ধোঁয়াশা থেকে বেশ বড়সড় একটা চাই সুট করে শুধু গাড়ীর ভেতরেই না, ঢুকে পড়লো তা মনের আকাশে!
ঘাড় ফিরিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললাম কি ব্যাপার দীপ্র, খেলা মানে তো খেলা। কিছুটা কড়া গলায় কথা কটি বলেই ব্যাপারটি হালকা করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তোমরা কি একটা মজার ঘটনা জানো, এই যে একটু আগে বার্ডস নেস্ট স্টেডিয়াম দেখলে, ওটা যে পাখীর বাসার মতো করে বানানো হয়েছে , সেই পাখীর বাসা কিন্তু চায়নিজ রা স্যুপ বানিয়ে খায়?
“পাখীর বাসার স্যুপ! ইয়াক! ওটা কি খাওয়া যায় নাকি? কি বলিস?” হেলেনের এই মন্তব্যের পিঠাপিঠি লাজু এসময় বলে উঠলো, “আর যাই করো এখানে আমি আর কোন স্যুপ খাচ্ছি না। খবরদার তুমিও কোন স্যুপ টুপের অর্ডার করবে না “আরে নাহ, আমরা তো আছি চায়নায় আম্রিকান খাবার বার্গার আর চিকেনের উপর। স্যুপের অর্ডার দেবার সুযোগ কই? স্যুপের অর্ডার দিলেই কি ওরা এই পাখির বাসার স্যুপ দেবে নাকি? অতো সস্তা নয় ওটা। অনেক দামী খাবার!
বাবা, কোথায় ঐ স্যুপ পাওয়া যায়? তোমরা না খেলেও আমি খেতে চাই ।” জানাল দীপ্র। লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক।