শিক্ষিত জাতি গঠনে গ্রন্থাগারই মূল চালিকা শক্তি

ড. মো. রফিকুল ইসলাম | রবিবার , ৪ জুন, ২০২৩ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতির মেধা ও মনন, ইতিহাসঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির ধারক ও লালনকারী হিসেবে গ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সে কারণে গ্রন্থাগার হলো সমাজ উন্নয়নের বাহন। আমরা জানি যে জাতির গ্রন্থাগার যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত। বর্তমান যুগে কোনো জাতির উন্নয়নের ব্যারোমিটার বা পরিমাপক যন্ত্র হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহারের পরিমাণ। অর্থাৎ যে জাতি যত বেশি পরিমাণে গ্রন্থাগার ও তথ্য ব্যবহার করে সে জাতি তত বেশি উন্নত হবে। এটাই স্বাভাবিক বিষয়। এছাড়াও যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। এর কারণ একটি জাতি উন্নতির পেছনে অবশ্যই গ্রন্থাগারের ভূমিকা রয়েছে।

গ্রিস দার্শনিক এরিস্টটল ও প্লেটোর মতে মহাজ্ঞানীরা গবেষণার তথ্যভাণ্ডার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংরক্ষণ করেন। যা গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করা যেতে পারে। কেননা জাপানি গ্রন্থাগারগুলো অনেক আকর্ষণীয়। যেখানে পাড়া ও মহল্লায় নগর প্রশাসনের গ্রন্থাগার রয়েছে। প্রতিটি নগর ও অঞ্চলের পৌর বা নগর গ্রন্থাগারে রয়েছে দু’টি বিভাগএকটি শিশুদের এবং অন্যটি বড়দের। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত জাপান দ্রুত শিক্ষা এবং গ্রন্থাগারের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল শিক্ষাগ্রহণ ও গ্রন্থপাঠের বিকল্প উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু হতে পারে না। জাপানিরা বাস্তবিক অর্থেই মনে করে, নিরক্ষর জনগণ দিয়ে কিছুকাল কাজ করানো সম্ভব। তবে চিরকাল নয়। সেখানে প্রতি মাসে গ্রন্থাগারে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ঋতুভিত্তিক, ঘটনাভিত্তিক গ্রন্থ ও বিশেষ সাময়িকী প্রদর্শনী এবং ঐতিহাসিক দলিলপত্রনিদের্শনা উপস্থাপন করা হয়। এসব প্রদর্শনীর মাধ্যমে গ্রন্থাগার ব্যবহারের প্রতি পাঠকদের আগ্রহ সৃষ্টি করারই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে জাপান ছাড়াও পৃথিবীর উন্নত দেশে বাসস্ট্যাণ্ডেও রেলস্টেশনে এমনকি হাসপাতালেও রয়েছে বুকস্টল। গ্রন্থাগার উন্নত বলেই জাপানের স্বাক্ষরতার হার শত ভাগ। এখানে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যে দেশের গ্রন্থাগার উন্নত সে দেশের স্বাক্ষরতার হার তুলনামূলক বেশি। যেমনআমেরিকা ও ব্রিটেন এসব দেশের স্বাক্ষরতার হার ৯৯%। তাই আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, শিক্ষিত জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

পাকভারত উপহাদেশের আমলে গ্রন্থাগারে বসে পড়াশুনা করার একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ওই সময়ে সরকার ও জমিদার শ্রেণি গ্রন্থাগার স্থাপনে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। সম্ভবত ইংরেজ শাসনামলে জেলা পর্যায়ে সাধারণ গ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়েছিল। বর্তমানে এ ধরনের গ্রন্থাগার উপজেলা পর্যায়ে বিদ্যমান রয়েছে। গ্রন্থাগার স্থাপনের পাশাপাশি একটি পাঠক শ্রেণিও সৃষ্টি হয়েছিল। যারা তাদের সময়কার নতুন প্রজন্মকে বই পড়তে উৎসাহিত করেছিলেন। এসব সাধারণ গ্রন্থাগারে শুধু বই নয়, দৈনিক পত্রিকা ও মূল্যবান সাময়িকী নিয়মিত সংরক্ষণ করা হতো। গ্রন্থাগারের একটি একক অবদান হলো জ্ঞানভাণ্ডারকে একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে পাঠক প্রেমিকদের ব্যবহারের জন্য জ্ঞানভাণ্ডারের উৎসসমূহ গ্রন্থাগারে নিয়মিত সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হতো।

পরবর্তীকালে দেশের সর্বজনীন শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার প্রয়োজনে গড়ে উঠে গণগ্রন্থাগার। তবে গ্রন্থাগারগুলোতে এখন সাধারণ পাঠক খুব একটা অধ্যয়নের জন্য আসে না। এর কারণ এখানে অধিকাংশই পাঠক বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতির জন্য তথ্যমূলক বই পড়তে আসে। দেশের গ্রন্থাগারগুলোর রুগ্ন অবস্থা এবং তরুণতরুণীদের গ্রন্থাগারবিমুখীতা তা মোটেও জাতীয় মননশীলতার জন্য ভালো ইঙ্গিত নয়। দেশের মেধাবী ও মানবীয় সমাজ ও সুনাগরিক গঠন সর্বোপরি সুশীল জাতি গঠনে খুবই হতাশাব্যঞ্জক। দেশের উন্নয়নের জোয়ারের পাশাপাশি জাতির জ্ঞানবিকাশে উন্নয়নের এত অবহেলা কাম্য নয়। দেশের উন্নয়ন ভাবনায় জ্ঞানতথ্যের উৎস অর্থাৎ গ্রন্থাগারই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। আর সৃজন ও মননশীল জাতি গঠনে গ্রন্থাগার উন্নয়ন ও বৃদ্ধিকরণের বিকল্প কিছু নেই। দেশের আদর্শিক শিক্ষার পরিশীলন, মূল্যবোধের চর্চা এবং চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে গ্রন্থাগারের প্রতি এই অমনোযোগ সুষম উন্নয়ন ধারাকে টেকসই হতে বাধার সৃষ্টি করবে বৈকি।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধ ভয়াবহভাবে অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার খুব কোনো সুযোগ নেই বললেই চলে। এতে বই পাঠের নেশা নয় বরং প্রাণঘাতী নেশা আমাদের কিশোর ও যুবসমাজকে বিপদগামী করছে। তাই এদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে। যাতে মন মেজাজকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলতে পারে এমন অনেক সর্বনাশ আকর্ষণ তরুণরাই সমাজে প্রতিনিয়তই ঠাঁই করে নিচ্ছে। এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের অবশ্যই মননশীল চিন্তার চর্চা বাড়াতে হবে। সরকারকেও ভাবতে হবে সমাজের মধ্যে যে সব চিন্তার চর্চাকে উৎসাহিত করতে হবে। এখন তরুণদের জীবনদর্শন নিয়ে ভাবার সুযোগ এসেছে। যুবসমাজ তথা তরুণদের শিক্ষিত হিেেসবে গড়ে তুলতে হলে সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র অথবা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তথাপি আমাদের দেশের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন কোনো দিনও সফল হবে না। যুবসমাজ তথা তরুণরাই সমাজের শক্তি। আমাদের দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ খুবই সামান্য। অর্থাৎ কয়েক কোটি টাকা বাজেট মাত্র। যে রাষ্ট্র অবকাঠামোগত স্থাপন নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে পারে। সেই রাষ্ট্র কেন সারা দেশে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার অবকাঠামো গড়ে তুলছে না। সেটা বিশাল তাৎপর্যময় একটি প্রশ্ন। বিশেষ করে দেশের সব থানা পর্যায়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন করে যুবসমাজকে গ্রন্থাগার মুখী করতে পারলে দেশের ভয়াবহ অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব।

এদিকে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। যা জাতির জন্য একটি বড় অবদান। তবে একজন ব্যক্তি কিংবা একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এমন ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সমাজের শত শত আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর মত মহৎ ব্যক্তির। যারা মনে প্রাণে গ্রন্থাগারকে উন্নত দেখতে চায়। তাই প্রয়োজন হবে এমন শিক্ষানুরাগী পণ্ডিত ব্যক্তিদের। আমরা যদি আমাদের নতুন প্রজন্মকে বই পড়ার কর্মীতে পরিণত করতে পারি। তবে দেশের অনেক সমস্যারই সমাধান হাতের মুঠোয় এসে পড়বে। তাই যে জাতি বই পড়ার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চায় আগ্রহী নয়। সে জাতি সাময়িকভাবে কিছু রঙিন সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারে না। তাই দেশের সব স্তরের মানুষকে বিশেষ করে ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদেরকে অধিকতর গ্রন্থাগার মুখী করে তোলা প্রয়োজন। কারণ জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের অবদান ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে দেশে বিদ্যমান গ্রন্থাগারগুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার উপর সর্বশেষ প্রকাশিত বই ও সাময়িকীর তথ্যাদি প্রদান, পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির কলাকৌশল সম্পর্কে আলোচনা ও মতবিনিময়, মননশীল সমাজ গঠনে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হলো শিক্ষিত জাতি গঠন সহায়তা করা। যা সমাজের এক এক একজন যুবকশ্রেণি গ্রন্থাগার প্রেমি হয়ে উঠবে। এক্ষেত্রে দেশে অনেক লেখক, গবেষক সংশ্লিষ্ট পেশাদার তৈরি হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম স্কুল থেকে বইপ্রেমী হয়ে উঠলে তবেই না আমরা মননশীল জাতি উপহার পাব।

লেখক: গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান,

সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধমার্কিন ভিসানীতি ও আমাদের অবশ মর্যাদাবোধ