দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দুপুরে অনাহারে থাকার একটি সংশয় তৈরি হলেও শেষতক জমিয়ে লাঞ্চ বলতে যা বুঝায় তার থেকে ঢের ভালো হয়েছে। এটিই হচ্ছে ভাগ্য। কেমন করে কোথায় যে আমার রিজিক লিখে রাখা হয়েছে! চীন বেড়াতে এসে বহু মানুষকে খাবারের কষ্ট করতে শুনেছি। বেইজিং শহরে একা একা বেড়াতে এসে আমিও সেই সংশয় সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সেই সংশয়ের মাঝে এমন জমকালো লাঞ্চ বেশ স্বস্তিদায়ক বটে। অবশ্য, চীনে আমাকে খাবারের তেমন কোন কষ্টে পড়তে হয়নি। স্বাদে কিছুটা গোলমাল থাকলেও ঝাল সস, কাঁচা মরিচ কিংবা লবণ মিশানোর সুযোগ অবারিত হওয়ায় আমি বেশ দিব্যি ম্যানেজ করে নিয়েছি। ডিমের স্বাদতো সারা দুনিয়াতেই একই রকম। ডিমের উপর একটু ঝাল সস দিয়ে দিলেই তো স্বাদ আমাদের মতো হয়ে যায়। চিংড়ী, রূপচান্দা কিংবা কোরাল মাছের স্বাদেও বেশ হেরফের আছে। তবে খুব একটা খারাপও লাগেনি। সবকিছু মিলে দুপুরের আন্তর্জাতিক লাঞ্চটিতে আমার ভাগে খাবারের স্বল্পতা থাকলেও অসাধারণ ছিল।

আমাদেরকে বাসে তুলে শুরু হলো নতুন পথে পথচলা। ভর দুপুরে একটু ঘুমাতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সেই সুযোগ নেই। বাসের সিটে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমানো যায়, কিন্তু বেইজিং শহরের নিত্যনতুন দৃশ্যগুলো এমনভাবে পেছনে যাচ্ছিল যে জীবনে এগুলো আর কখনো সামনে পড়ার সম্ভাবনা নেই। অতএব সবকিছু দেখার জন্য জোর করে চোখ খুলে রেখে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম।

কী সুন্দর একটি শহর! একেবারে তকতকে ঝকঝকে। রাস্তার দুপাশে সুউচ্চ সব ভবন। এক একটি ভবন যেনো আকাশ ছুঁয়ে যাবে। ভবনগুলোর ডিজাইন যে কী নান্দনিক! দেখতে মনে হচ্ছে সবগুলো ভবনই কাচের। সূর্যের আলোতে চিকচিক করছে। মার্কারী গ্লাসের নীলাভ আবহ চারদিকের পরিবেশে ভিন্ন একটি মাত্রা দিয়েছে। নীল আকাশের নিচে অসংখ্য নীল ভবন, ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় গাছের চোখজুড়ানো সবুজ মন ভরিয়ে দিচ্ছিল।

রাস্তায় প্রচুর গাড়ি। প্রচুর মানে হাজার হাজার। কিন্তু আমাদেরকে কোথাও অচল হয়ে আটকে থাকতে হচ্ছে না। গাড়ি চলছে। সবগুলো গাড়ি ছুটছে। সড়কের মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতে কিছুটা জট থাকলেও সবুজ বাতি জ্বলার সাথে সাথে চাকা ঘুরতে শুরু করে। ঠিক কী পরিমাণ সাইকেল ও মোটর সাইকেল যে এই মুহুর্তে রাস্তাটি রয়েছে তা গুনে শেষ করা অসম্ভব। সাইকেল নিয়ে ছুটছে কিশোর, যুবক বৃদ্ধ। নারী পুরুষের যেন বাছ বিছার নেই সাইকেলে। কত রঙের কত ডিজাইনের সাইকেল যে দেখা গেল!

বিস্তর চওড়া ফুটপাত। মনে হয় রাস্তার অর্ধেকই ফুটপাত বানিয়ে রাখা হয়েছে। প্রচুর মানুষ হাঁটছে সেই সুন্দর ফুটপাত ধরে। অগুনতি নারী পুরুষ ও শিশু। মহিলার সংখ্যা বেশ বেশি বলে মনে হচ্ছিল। যেদিকে তাকাচ্ছিলাম সেদিকে দেখা যাচ্ছিল নারী, ব্যস্ত নারী।

আমাদেরকে বেশ সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে আসা হলো। বাস থামার পর মিজ পিনং বললেন, আমরা একটি মন্দির দেখতে এসেছি। মন্দিরটি ৫শ’ বছরেরও বেশি পুরানো। এটির নাম টেম্পল অফ হেভেন বা স্বর্গের মন্দির। পৃথিবীতে যত ধর্ম রয়েছে সব ধর্মের প্রতিই রয়েছে আমার শ্রদ্ধা। যে যার মতো ধর্ম পালন করবে, তার সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করবে। তার ভালোমন্দ কাজের হিসেব দেবে। পৃথিবীতে কোন ধর্মই কোনদিনই কোন খারাপ কাজ করতে বলেনি, চীনে এখন আমি যে মন্দিরে এসেছি সেটির অনুসারীদেরও নিশ্চয় খারাপ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দেয়া আছে। তবে মন্দিরটি ঠিক কোন ধর্মের বা কারা পূজো অর্চনা বা ধ্যান জ্ঞান করে তা আমার জানা নেই। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবাই এই মন্দিরে আসেন নাকি তাদের মধ্যেও আবার জাতপাত, কিংবা আক্বিদার কোন ভেদাভেদ আছে কিনা তাও অজানা। তবে যে কোন ধর্মীয় স্থানেই একটি ভাবগম্ভীর পরিবেশ থাকে, অন্যরকমের একটি পবিত্রতা বিরাজ করে। বেইজিংএর এই স্বর্গ মন্দিরে তেমনটি চোখে পড়েনি। পিনং বললেন যে, এটিতে এখন আর কেউ প্রার্থনা করে না। এটি পুরোপুরি ট্যুরিস্ট স্পর্ট। একটি ট্যুরিস্ট স্পট এমন স্নিগ্ধ!

বেইজিং এর প্রাণকেন্দ্রে ২৭৩ হেক্টর এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা স্বর্গমন্দিরটি ফরবিডেন সিটি বা নিষিদ্ধ নগরীর চেয়ে দুই গুণ বড়। ১৯১৮ সালে স্বর্গমন্দির এলাকাকে একটি উদ্যানে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়। সাজিয়ে গুছিয়ে গাছগাছালীতে ভরে তোলা হয় চারদিক। আগে থেকে গাছ গাছালী থাকা স্থানটিকে চমৎকার একটি উদ্যানের আদল দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। বর্তমানে এই উদ্যানে গাছের সংখ্যা কয়েক লাখ। এরমধ্যে অনেকগুলো বৃক্ষের বয়স ৫ থেকে ৭শ’ বছর! উদ্যানটি গড়ে তোলার পরই এটি শিশু কিশোর যুবা বৃদ্ধসহ সব বসয়ী নারী পুরুষের বেড়ানোর একটি চমৎকার জায়গা হয়ে উঠে। ক্রমে হুমড়ি খেয়ে পড়তে থাকেন হাজারো বিদেশী। আর এভাবে ক্রমে এটি বেইজিং এর একটি বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠে। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক এই নিদর্শনটি সংরক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এটিকে আরো নান্দনিক করে তোলে।

মিজ পিনং বললেন, মন্দিরটির গোড়াপত্তন হয় পঞ্চদশ শতাব্দির শুরুতে। ১৪০৩ সালে চীনের শাসনকর্তাদের প্রসাদ যখন নানজিং থেকে বেইজিংএ স্থানান্তর করা হয় তখন এখানে মন্দির গড়ে তোলার একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়। মিং রাজবংশের সম্রাট ইয়োং ল্যে তার শাসনক্ষমতার অষ্টাদশ বছরে এসে ১৪২০ সালে মন্দিরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে মিং রাজা চিয়াচিং এবং ছিং রাজা ছিয়েন লোং মন্দিরটির উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেন। এই দুই সম্রাট মন্দিরের নানাদিকে পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন করেন। এটি মূলতঃ মিং এবং ছিং রাজবংশের স্বর্গপুজার স্থান।

একসময় এটি চীনের সবচেয়ে বড় থিয়েন থান বা স্বর্গমন্দির ছিল। এখন নাকি আরো কয়েক স্থানে বড় স্বর্গমন্দির গড়ে উঠেছে। চীনা সম্রাটেরা নিজেদের থিয়েন যি বা স্বর্গের সন্তান বলে দাবি করতেন। সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতেন যে, সম্রাটেরা স্বর্গের সন্তান। তাদের ক্ষমতা, শক্তি, সাহস, ঐশ্বর্য সবকিছু আসে স্বর্গ থেকে। তাই স্বর্গের সন্তানদের বিরুদ্ধে কিছু করা মানে পাপী হওয়া। নরকে শাস্তিভোগ করা। এতে করে পারতপক্ষে কেউ সম্রাটদের বিরুদ্ধাচারণ করতেন না। পূজো অর্চনা করে সম্রাটদের সন্তুষ্টি কামনা করতেন।

মিজ পিনং আমাদের যা বললেন এবং নেট দুনিয়ায় খোঁজখবর করে জানা গেলো যে, সাত বছর আগেকার ওসব দিনে চীনারা মনে করতেন পৃথিবীর চেয়ে আকাশের মর্যাদা অনেক বেশি। তাই আকাশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক নিরন্তর চেষ্টা থাকতো তাদের মাঝে। এই মন্দিরটি নির্মাণেও আকাশকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মন্দিরটি গোলাকার, চারদিকে বর্গাকার দেয়া। আবার উত্তর মন্দির অংশটি গোলাকার অন্যদিকে দক্ষিণের মন্দিরটি বর্গাকার। ওই সময় বিশ্বাস করা হতো যে, স্বর্গ গোলাকার আর পৃথিবী বর্গাকার। স্বর্গ এবং পৃথিবীকে একই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতেই স্বর্গ মন্দিরের নির্মাণ শৈলীতে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। অনন্য সুন্দর এই নির্মাণশৈলী এত বছর পরেও মানুষকে মুগ্ধ করে।

স্বর্গমন্দিরটিতে ছোটবড় মিলে ছয়শ’রও বেশি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলোর কোনটিকে প্রার্থনা, কোনটিতে সংগীত, কোনটিতে চীনা সংস্কৃতির নানা আয়োজন থাকে। তবে এই মন্দিরের একটি বড় আকর্ষণ হচ্ছে ‘প্রতিধ্বনি দেয়াল’। বৃত্তাকার এই দেয়ালটি ২ হাজার ১৩৬ ফুট লম্বা এবং ১২. ২ ফুট উঁচু। এই দেয়ালের যে কোন জায়গায় কোন শব্দ করলে তা পুরো দেয়াল ঘুরে আবার ফিরে আসে। অন্যরকমের একটি প্রতিধ্বনী করে। দেয়ালটি নির্মাণে ঠিক কী ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল কে জানে!

আমরা এদিক ওদিক ঘুরলাম। নানাকিছু দেখলাম। কৌতুহলের শেষ নেই মন্দিরের চত্বর জুড়ে। চমৎকার এক আবহের মাঝে বাগানেও ঘুরলাম। চমৎকার সব গাছগাছালীর ভিতরে ঘুরতে অন্যরকমের একটি ভালোলাগা কাজ করছিল। একা একা কিছুটা খারাপ লাগলেও চারপাশের সৌন্দর্য মাতোয়ারা করতে বেশি সময় নেয়নি। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদীতে একাত্তরের মার্চ
পরবর্তী নিবন্ধশহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে যেন ভুলে না যাই