দৈনিক আজাদীতে একাত্তরের মার্চ

এ.কে.এম. আবু বকর চৌধুরী | বুধবার , ২৯ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১৮ই মার্চ : প্রথম সংবাদ (৪ কলাম) ‘দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষে শেখ মুজিব / আমাদের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া অবধি সংগ্রাম চলিবে।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) ‘হালিশহরের জনসভায় মাওলানা ভাসানি / পূর্ব বাংলার জনসাধারণ আওয়ামী লীগের শাসন মানিয়া লইয়াছে। সভার বিবরণীতে বলা হয় পূর্ব বাংলা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গতকল্য এখানে বলেন যে, দেশের শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শাসন বাতিল করিয়া দিয়াছে এবং জনসাধারণ আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন মানিয়া লইয়াছে।’ দুই কলাম সংবাদ ‘গণঅধিকার আদায়ে শেষ রক্তবিন্দু ও দিবঃ মুজিব। দুইটি এক কলামের সংবাদে ‘শহরে / ডাক্তার / নার্স / উকিলদের মিছিল ও মুজিব সকাশে / মাওলানার তার।’ ৪র্থ পৃষ্ঠায় দুই কলাম সংবাদ-‘বাংলার মুক্তি সংগ্রাম সপ্তম দিবসে উপনীত’।

১৯শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৬ কলাম) ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা। সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োজিত সীমিত ক্ষমতায় তদন্ত কমিশন / বাংলার জনগণ গ্রহণ করিবে না।’ এক কলাম সংবাদে ‘ভুট্টো ঢাকা আসিতে নারাজ।’ ৩ কলাম ব্যাপী সংবাদ – ‘ধানমণ্ডি জন সমাবেশে শেখ মুজিব/কেহ যদি আমাদিগকে আঘাত হানে তবে আমরাও অবশ্যই প্রতিঘাত হানিব। এতে বলা হয় আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ এবং কেহই তাহাদিগকে বুলেট ও মেশিন গান দ্বারা স্তব্ধ করিয়া দিতে পারিবে না। জনগণ নিশ্চিতভাবেই বিজয়ী হইবে।’ দুই কলামের সংবাদ ‘প্রেসিডেন্টের প্রতি জহুর আহমদ চৌধুরী আহ্বান / খাদ্য শস্যবাহী জাহাজগুলি অবিলম্বে ফিরাইয়া দিন।’ এক কলামের ‘ঘটনা তদন্তের উদ্দেশ্যে / তিন জন আওয়ামী লীগ নেতা আজ চট্টগ্রাম আসবেন।’ ৪র্থ পৃষ্ঠায় এক কলাম সংবাদে– ‘অসহযোগ আন্দোলনের / অষ্টাদশ দিবস অতিবাহিত।’

২০শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলাম) ‘নিরস্ত্র জনতার সহিত সংঘর্ষ ও সান্ধ্য আইন জারী / জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর বেপরোয়া গুলি বর্ষণে ৪০ ব্যক্তি আহত। এতে বলা হয় জনতা অদ্য সকালে জয়দেবপুর অস্ত্র নির্মাণ কারখানা দখলের চেষ্টা করিলে সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণে ১৩ ব্যক্তি নিহত ও ২৭ ব্যক্তি আহত।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) ‘আজ ইয়াহিয়ামুজিব ৪র্থ দফা বৈঠক/ফর্মুলা উদ্ভাবনে উপদেষ্টাদের আলোচনা অনুষ্ঠিত। দুইটি ৩ কলামের সংবাদ আর কত রক্ত দিতে হইবে। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য তোমাদের আরও কত রক্তের প্রয়োজন? ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি মাওলানা ভাসানীর উপদেশ / বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করুন।’

২১শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘চতুর্থ দফা বৈঠক শেষে শেখ মুজিবের মন্তব্য / আলোচনা কিছুটা অগ্রগতি লাভ করিয়াছে। সোমবার পঞ্চম দফা বৈঠক।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) – ‘প্রেসিডেন্টের ব্যাখ্যা পি.পি. প্রধান সন্তুষ্ট হইয়াছেন / অদ্য সদলবলে জেড এ ভুট্টোর ঢাকা আগমনের সম্ভাবনা।’ দুটি দুই কলাম সংবাদে – ‘শেখ মুজিবুর রহমান / বাংলাদেশকে উপনিবেশ করিয়া রাখা যাইবে না’ ও ‘বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানকল্পে / ঢাকা রাজনৈতিক দল প্রধানদের তৎপরতা’ এক কলামে ‘শেখ মুজিবের আহ্বান / শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইয়া যান।’ অপর তিন কলাম সংবাদে ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উদ্যোগে / প্রাক্তন সৈন্য ন্যাশনাল গার্ড, ইউ ওটিসি বাহিনীর সম্মেলন অনুষ্ঠিত’। ৪র্থ পৃষ্ঠায় ২ কলাম সংবাদ – ‘অসহযোগ আন্দোলনের / ঊনিশতম দিবস অতিবাহিত’।

২২শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘কতিপয় বিষয়ের ব্যাখ্যালাভের উদ্দেশ্যে / প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিব সোয়া এক ঘন্টাকাল অনির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) ‘পলোগ্রাউন্ডের জনসভায় মাওলানা ভাসানী / কোন শক্তিই ঐক্যবদ্ধ বাঙালিদের অগ্রগতি রোধ করিতে পারিবে না।’ ৩ কলামের অপর সংবাদে – ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনার্থে / সশস্ত্র বাহিনীর কড়া নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাধীনে ভুট্টোর ঢাকা আগমন।’ এতে বলা হয় বিমান বন্দর হইতে হোটেল পর্যন্তপথের দুই পার্শ্বে দণ্ডায়মান জনতা পি.পি.পি. চেয়ারম্যানকে টিটকারী প্রদান করেও বিদ্রুপাত্মক ধ্বনি দেয় ‘ভুট্টো ফিরে যাও’ প্রভৃতি ধ্বনি শুরু হয়।’ ২ কলামের এক সংবাদ ‘জনসমাবেশে শেখ মুজিবের ঘোষণা / দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন শিথিল হইবে না।’ চারটি এক কলাম সংবাদ – ‘২৩ শে মার্চ প্রতিরোধ দিবস’। এতে বলা হয় ‘আগামী কাল শহর ছাত্রলীগ প্রতিরোধ দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে, শেখ মুজিব কর্তৃক / মাওলানার ভাসানীর নিকট বিশেষ দূত প্রেরণ, ঢাকায় / পঃ পাকিস্তানী নেতাদের বৈঠক’ ও ‘শেখ মুজিব সকাশে / .কে. ব্রোহী।’

২৩শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৫ কলামের) ‘মতৈক্যের ক্ষেত্রে সম্প্রসারণের সুযোগ প্রদানার্থে / পঁচিশে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত ঘোঘণা।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) – ‘ইয়াহিয়ামুজিবভুট্টো/ ত্রিপাক্ষিক আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত।’ ৩ কলামের অপর সংবাদ – ‘সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো / ইয়াহিয়ামুজিব মতৈকের শর্ত পরীক্ষার করিয়া দেখিতেছি।’ দুই কলামের এক সংবাদ ‘শেখ মুজিবের ডাকে / অসহযোগ আন্দোলনের ২১তম দিবস অতিবাহিত।’

২৪শে মার্চ : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সংবাদপত্রসমূহ বন্ধ ছিল।

২৫শে মার্চ : প্রথম সংবাদ (৬ কলামের) : ‘চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর গুলি বর্ষণ / তিন ব্যক্তি নিহত ও ৪ জন আহত’ এতে বলা হয় – ‘সোয়াত জাহাজ হইতে গতকল্য অপরাহ্নে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করিয়া সরাইয়া আনিবার প্রচেষ্টা চালাইলে স্থানীয় লোকজন ইহার প্রতিবাদ জানায়’। দ্বিতীয় সংবাদ (২ কলাম) : ‘সমাগত জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবের ঘোষণা / বাংলার জনগণকে অবশ্যই মুক্ত করিব।’ এক কলাম সংবাদে – ‘জনাব ভুট্টো বলেন / কিছু অগ্রগতি সাধিত হইয়া থাকিবে।’

২৬শে মার্চ প্রথম সংবাদ (৫ কলাম) : ‘সর্বত্র জনমনে চরম উত্তেজনা / সামরিক বাহিনীর গুলিতে চট্টগ্রামের নিহতদের সংখ্যা ২০ জনে উন্নীত।’ এতে বলা হয় – ‘একটি জাহাজ হইতে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা বারুদ অপসারণকে কেন্দ্র করিয়া গত বুধবার বন্দর এলাকায় জনতার উপর গুলি বর্ষণ করিলে ৪ জন নিহত এবং বহু সংখ্যক লোক আহত হয় বলিয়া অনুমান করা যাইতেছে।’ দ্বিতীয় সংবাদ (৩ কলাম) – ‘সংগ্রামী জনতার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব / অধিকার আদায়ের সংগ্রামের চরম আত্মোৎসর্গের জন্য প্রস্তুত হউন।’ এক কলাম সংবাদে – ‘সংকট সমাধানে / অহেতুক বিলম্ব হইতেছে।’ সংবাদ প্রকাশ – ‘শেখ মুজিবুর রহমান অদ্য রাত্রে এখানে বলেন যে, বর্তমান সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের বিলম্বিত করার কোন কারণ বা যৌক্তিকতা নাই।’ শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন যে, ‘সংশ্লিষ্ট মহল তাহা চাহিলে তাহাদের উপলব্ধি করা উচিত যে, সংকটের আশু সমাধান করা তাহাদেরই কর্তব্য।’ অপর এক কলামের ভুট্টো বলেন – ‘আলোচনা জটিল হইয়া পড়িয়াছে। দুই কলামে এক সংবাদ – ‘স্বেচ্ছাসেবকসেবিকা সমাবেশে জহুর আহমদ চৌধুরী / সেনাবাহিনী জনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করিয়াছে। সমাবেশে নুর মুহাম্মদ চৌধুরী ও শাহ বদিউল আলম সালান প্রদান করিয়াছে। অপর দুই কলামে ‘সেনাবাহিনীর গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে আগামীকাল সমগ্র বাংলাদেশে হরতাল।’

যে কোন সংবাদ পত্রের সম্পাদকীয় হল তার নিজস্ব সম্পদ বা স্পষ্ট করে বলতে গেলে সম্পাদকীয় বক্তব্যের মাধ্যমে তার মৌলিক চরিত্র বা চিন্তা ধারা প্রকাশ করে, তাই ১লা মার্চ হতে ২৬শে মার্চ পর্যন্ত দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সম্পাদকীয়গুলোর মূল বক্তব্য সমূহ নিম্নে তুলে ধরলাম। এই ২৬ দিনই মোট ১৬টি সম্পাদকীয় ছিল এবং ২৬ শে মার্চ দুই কলাম ব্যাপী ৪ প্যারায় ৩০ লাইনের ‘ইহা কি অপরিহার্য ছিল?’ শীর্ষক সম্পাদকীয়টি ছিল সর্বশেষ সম্পাদকীয়।

) ৩রা মার্চ ‘গণতন্ত্র চরম পরীক্ষার সম্মুখীন’ : ‘প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন ৩রা মার্চ তারিখ আহুত হইবার পর পহেলা মার্চ তারিখের অপর এক আদেশে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করার ঘোষণার ফলে সমগ্র দেশে এক জটিল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি উদ্ভব হইয়াছে। গণতন্ত্র আজ চরম পরীক্ষার সম্মুখীন। আমরা বিশ্বাস করি এখনো পরিস্থিতির কোন অবনতি ঘটে নাই। সরকার পরিষদের অধিবেশন অনতিবিলম্বে আহ্বান করিয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজকে সহজতর করিতে পারেন।’

) ৪ঠা মার্চ। ‘গণতন্ত্র চরম পরীক্ষার সম্মুখীন’ : ‘গণতন্ত্র আজ চরম পরীক্ষার সম্মুখীনএই কথাটি আমরা গতকালও বলিয়াছিলাম, আবার আজও বলিতেছি। গতকাল সরকারের প্রতি আমাদের আবেদন ছিল, আজ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণের প্রতি আমরা আবেদন জানাইতেছি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্পে আজ দেশে আন্দোলন চলিতেছে।প্রত্যয়ের সহিত সংযমের সমন্বয় ঘটিলেই আন্দোলন তীব্র হয়’

) ৫ই মার্চ। ‘গণ রায়ের মর্যাদান দান’ : ‘পার্লামেন্টারী দলগুলির নেতৃবৃন্দের যে বৈঠক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আহ্বান করিয়াছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধানের পক্ষে তা প্রত্যাখ্যান করা ব্যতীত যে গত্যন্তর ছিল না সহজেই তা উপলব্ধি করা যায়।নির্বাচিত জাতীয় পরিষদকে এড়াইয়া গিয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যদি বাধ্য করার উদ্দেশ্যে পুরাতন কায়েমী স্বার্থ আজ দেশের সামনে এক সংকট সৃষ্টি করিয়াছে। বৈঠকে যোগ দেওয়া মানে এই সংকটের যথাযথ স্বীকার করিয়া লওয়া এবং মূল শাসনতন্ত্রের প্রশ্ন ছাড়িয়া দিয়া কৃত্রিম বিষয়ের আলোচনায় সময় নষ্ট করা। কাজেই এই সংকটের ব্যাপারে মাথা ঘামাইয়া এখন কর্তব্য হইতেছে গণপ্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র তৈরী করিতে দেওয়া।’ (চলবে)

লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২৯০)-শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্মজীবী নারী
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে