দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দিল্লীর রাস্তায় ছুটছে আমাদের গাড়ি। কখনো দ্রুত, কখনোবা শ্লথ গতিতে। ট্রাফিক সিগন্যালের পাশাপাশি জ্যামেও আটকা পড়ছিলাম। একেবারে থেমে যেতে হচ্ছিল আমাদের। অগুনতি মানুষ রাস্তায়, হাজার হাজার গাড়ি। মানুষ এবং গাড়ির আনাগোনায় ব্যস্ত জনপদ। শত শত বছরের ঐতিহ্য মোড়ানো মেগাসিটি দিল্লীতে এমন ভিড়ভাট্টা না থাকলে যেন মানাতোই না। রাজা বাদশাহর শহর দিল্লী। শত শত বছরের রাজধানী। ভোগবিলাস এবং জৌলুশের নানা আয়োজনের পাশাপাশি ঐতিহ্যের পরশও চারদিকে। স্ত্রীর হাতটি হাতে নিয়ে বসে আছি গাড়িতে। গাড়ি ছুটছে। হুমায়ুন’স টম্প থেকে বের হয়ে পথ চলছি আমরা। দিল্লী জামে মসজিদ দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন ড্রাইভার। দিল্লী জামে মসজিদ আগেও আমরা দেখেছি। দিল্লীতে এসে এসবই দেখতে হয়। সিনেমা টিনেমা দেখে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই, ইচ্ছেও নেই। আমি ঘুরতে পছন্দ করি, আমার স্ত্রীও। এতে করে চরকার মতো ঘুরলেও আমার স্ত্রীর কোন আপত্তি নেই।
তার অনাপত্তি আমাকে আরো উসকে দেয়। আমি ঘুরতে থাকি।
আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সাথে থাকা এই চালকই গন্তব্য ঠিক করছেন। শিখ ধর্মাবলম্বী ‘সর্দারজী’ আমাদেরকে দিল্লী জামে মসজিদের সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ঘুরে আসুন। আমি এদিকেই থাকবো। ফোন করবেন।
দিল্লী জামে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালাম। মিনারগুলো উজ্জ্বলভাবে দাঁড়িয়ে আছে। দিল্লীর অন্যতম ঐতিহ্যমন্ডিত এই মসজিদ সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেন। এই মসজিদের নির্মাণের জন্য মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর উজির বা প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ খানকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৬৪৪ সাল থেকে ১৬৫৬ সালে এটির নির্মাণ সম্পন্ন হয়। অন্তত পাঁচ হাজার শ্রমিক ওই সময় মসজিদটি নির্মাণে নিজেদের শ্রম ও মেধা খরচ করেছিলেন। শুধু পারিশ্রমিক নয়, একটি মসজিদ নির্মাণে নিজেদের অংশগ্রহনের তৃপ্তিও তাদের ছিল। মসজিদটি নির্মাণে ওই সময় রাজকোষ থেকে প্রায় দশ লাখ রূপী খরচ করা হয়েছিল। মসজিদটির নাম ‘মসজিদ-ই জাহান-নুমা’। এর অর্থ ‘জগতের প্রতিবিম্ব মসজিদ’। কিন্তু কালের বিবর্তনে মসজিদের নাম পাল্টে শুধুমাত্র ‘দিল্লী জামে মসজিদ’ হয়ে গেছে। বর্তমানে মসজিদটিকে আসল নামে আর কেউ চিনে না, ডাকেও না। বিশাল মসজিদটিতে একই সাথে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। সম্রাট শাহজাহান কিংবা পরবর্তী সম্রাটেরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। লালকেল্লার সাথে এই মসজিদের দূরত্ব খুব বেশি নয়।
১৮৫৭ সালে মুঘল সাম্রাজ্যকে তছনছ করে দিয়ে ব্রিটিশ বাহিনী যখন দিল্লীর হর্তাকর্তা তখন তারা মসজিদটিতে নামাজ আদায় বন্ধ করে দেয়। তারা মসজিদটি বাজেয়াপ্ত করে সৈন্যদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ব্রিটিশ বাহিনী মসজিদটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের মুখে মসজিদটি রক্ষা পায়।
লাল বেলেপাথর এবং মার্বেল দিয়ে তৈরি মসজিদটি দৈর্ঘ্য ৪০ মিটার বা ১৩১.২৩ ফুট। প্রস্থ ২৭ মিটার বা ৮৮.৫৮ ফুট। মসজিদটিতে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। রয়েছে দুইটি সুউচ্চ মিনার।
মিনারের উচ্চতা ৪১ মিটার বা ১৩৪.৫১ ফুট। মসজিদের ভিতরে দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে দারুণ ক্যালিওগ্রাফি। পবিত্র কোরানের নানা আয়াত খুদিত রয়েছে পাথরে। অত্যন্ত নান্দনিক মসজিদটি নানামুখী অত্যাচারে জৌলুশ হারালেও ঐতিহ্য রয়ে গেছে। মসজিদটির পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্যরকমের শিল্প, মমত্ব। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরলাম আমরা। নানা কিছু দেখলাম। উন্মুক্ত মসজিদ চত্বরে অগুনতি কবুতরের উড়াউড়িও ভিন্ন এক আবহ তৈরি করেছে।
আবারো ছুটছে আমাদের গাড়ি। চালক জানালেন, মসজিদ দেখলেন এবার একটি মন্দির দেখেন। দেখার ব্যাপারে আমাদের কোন আপত্তি নেই, করলামও না। ড্রাইভার আমাদেরকে লোটাস মন্দিরে নিয়ে গেলেন। ওখানেও গেটে নামিয়ে দিয়ে সরে পড়লেন তিনি। বললেন, ফোন করলে এসে নিয়ে যাবেন।
দিল্লীর লোটাস মন্দির হল বাহাই ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের মন্দির। চমৎকার এক স্থাপত্য সমৃদ্ধ এই মন্দিরটি পদ্ম ফুলের মতো। তাই এটির নামও লোটাস টেম্পল। মন্দিরটির ঐহিত্য না থাকলেও সমৃদ্ধি আছে। ১৯৮৬ সালে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া মন্দিরটি শুধু বাহাই সম্প্রদায় নয়, ইচ্ছে করলে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও বসে ধর্মাচার করতে পারে। বিশ্বের নবীনতম ধর্ম হচ্ছে বাহাই। তাই তাদের মন্দিরও নবীন। কিন্তু অত্যন্ত নান্দনিক। দিল্লী শহরের বুকে বিস্তৃত একটি এলাকা নিয়ে মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। অত্যন্ত শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে মন্দিরটি পরিচালিত। দারুণ আয়োজন চারদিকে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মন্দিরের বহু দূরে জুতা খুলে ফেলতে হয়। পরবর্তীতে এক ধরনের পলিথিনে পা মুড়িয়ে যেতে হয় মন্দিরের ভিতরে।
আগেই বলেছি, লোটাস টেম্পল বেশি পুরানো স্থাপনা নয়। কিন্তু এর নান্দনিকতা নির্মাণ শিল্পের বড় বিস্ময়। মন্দিরটির নির্মাণে প্রধান স্থাপত্যশিল্পী ছিলেন বাহাই ধর্মাবলম্বী ফেরীবোর্জ সাহবা। তিনি দারুণ দক্ষতায় অত্যন্ত ভালোবেসে মন্দিরটির নকশা তৈরি এবং নির্মাণ সম্পন্ন করাতে সক্ষম হয়। তার জীবদ্দশাই মন্দিরটি ‘বিস্ময়কর স্থাপনা’র গৌরব অর্জন করে। মন্দিরটিতে পদ্মফুলের ২৭ টি পাপড়ি ব্যবহার করা হয়েছে। এসব পাপড়িতে গ্রীসের মাউন্ট পেন্টেলি বা পেন্টেলি পর্বত থেকে আনা বিশেষ ধরনের মার্বেল ব্যবহার করা হয়েছে। সুবিশাল মন্দিরটিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা নেই। তবে বিশেষ কায়দায় ন্যাচারাল ভেন্টিল্যাশন টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে মন্দিরটিতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস এবং ঠান্ডা থাকে। পাপড়িগুলো স্থাপনের মাঝেই এই টেকনিক লুকায়িত রয়েছে। অনন্য সুন্দর মন্দিরটি বিশ্বের নির্মাণ শিল্পে নানাভাবে প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হয়েছে।
লোটাস টেম্পল থেকে বের হয়ে আমরা রাজঘাট মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সমাধি দেখতে গেলাম। গেটে ভীষণ কড়াকড়ি। আমার স্ত্রীর ব্যাগ স্কেনিং করে ঢুকতে দেয়া হলো। গান্ধীজির সমাধি ক্ষেত্র বেশ সুন্দর। চমৎকার বাগানের ভিতরে গড়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে একটি যাদুঘরও। সেখানে গান্ধীজির ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে। অহিংসবাদী ধারায় বিশ্বাসী গান্ধীকে নির্মমভাবে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৯৪৮ সালে। গান্ধীর সমাধিকে ঘিরে রাজঘাটে ভিন্নমাত্রার একটি আবহ দেয়া হয়েছে। হাজারো গাছগাছালীতে ছায়া সুশীতল পুরো এলাকা।
শিখ ধর্মাবলম্বী চালক এবার তাদের মন্দির দেখানোর বায়না ধরলেন। বললেন, চলেন, এবার আমাদের গুরুদুয়ারা দেখতে। শিখদের মন্দিরকে গুরুদুয়ারা বলে। অবশ্য কোনকিছুতেই আমাদের কোন আপত্তি নেই। দেখার ক্ষেত্রে জাত ধর্ম কোন বাধা নয় আমাদের কাছে। অতএব সর্দারজীকে ‘আচ্ছা’ বলতেই তিনি গাড়ি ছুটালেন গুরুদুয়ারার দিকে।
ভারতে দুই কোটিরও বেশি শিখের বসবাস। চন্ডীগড়ে প্রচুর শিখ বসবাস করেন। তবে দিল্লীতেও এই সংখ্যা খুব একটা কম নয়। হাজার হাজার শিখ রয়েছেন দিল্লীতে। রয়েছে তাদের মন্দির, গুরুদুয়ারা। এসব মন্দির থেকে ধর্মাচারের পাশাপাশি প্রতিদিনই বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়। খাওয়ানো হয় ক্ষুধার্ত মানুষদের।
দিল্লীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত গুরুদুয়ারা বাংলা সাহেব এমনই একটি জায়গা। যেখানে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ পেটপুরে খাবার খান। জাত পাতের কোন ভেদাভেদ নেই। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যার ইচ্ছে এখানে বসে খাবার খেতে পারেন। একাধিকবার খেলেও কেউ বাধা দেয় না।
আমাদের ড্রাইভার কাছে আসলেন। খাবার খাবো কিনা জানতে চাইলেন। বললেন, এখানে ফ্রি খাবার দেয়া হয়। প্রতিদিন অন্তত ২৫ হাজার মানুষ ফ্রিতে খাবার খান। বলে কি! প্রতিদিন ২৫ হাজার মানুষের খাবার! এ যে এক এলাহী কারবার। কিন্তু মন্দিরের খাবারটি ক্ষুধার্ত কোন মানুষ খেলে উপকার হবে। আমরা না খেলে আরো তিনজন ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার পাবেন। তাকে এখানে না খেয়ে আমরা বাইরে একসাথে লাঞ্চ করবো বলে জানালাম। তিনি আমাদের কাছ থেকে এক মিনিট সময় চেয়ে নিয়ে মন্দিরের দিকে ছুটলেন এবং ভক্তিভরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পিছু আসলেন। মন্দিরের ভিতরে বাইরে আয়োজন অনেক। নানাকিছু সামলাতে ব্যস্ত শত শত মানুষ। অগুনতি মানুষের ভালোবাসা এবং ভালোলাগার গুরুদুয়ারার সার্বিক কার্যক্রমে আমরা দুজনই মুগ্ধ হলাম। বিশেষ করে প্রতিদিনই ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার দেয়ার মানবিক কার্যক্রম অসাধারণ এক আয়োজন বলে মনে হলো। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধটিকা : চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ