১৯৬৪ সাল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন অবৈধভাবে ক্ষমতাদখলকারী ফিল্ড মার্শাল আইউব খান। তিনি দশ বছর শাসন করেছিলেন পাকিস্তানকে। তার আমলে, তার নির্দেশেই বঙ্গবন্ধুর নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীকার আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। বাঙালির দাবি আদায়ের আন্দোলন দমন করতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েছিলেন এই সামরিক ডিকটেটর। তবে যেকোনো কারণেই হোক সে স্বৈরশাসকের সময়ে একটি ভালো কাজ করেছিল তার সরকার।
১৯৬৪ সালে স্থানীয় প্রশাসন জালালপুর গ্রামের পাশে শাহ আবদুল করিমের নামে ২ একর ১১ শতক জমি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল শাহ আবদুল করিমের বাড়ি দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের উজানধল গ্রামে।
কাগজপত্র বুঝে পেয়ে জমির খাজনা নিয়মিত পরিশোধ করলেও দীর্ঘ ৫৭ বছর জায়গার কাছেও যেতে পারেননি শাহ আবদুল করিম ও তার পরিবার। অসংখ্য জনপ্রিয় গানের রচয়িতা শাহ আবদুল করিম ভূমিহীন ছিলেন। উজানধল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে করিমের প্রিয় নদী কালনি। নদীর উত্তর পারে উজানধল এবং দক্ষিণ পারে জালালপুর ও তাড়ল গ্রাম। বাউল করিমের নিজের কোনো জমিজিরাত ছিল না।এই জমি তাঁর নামে রেকর্ড হয়েছে। শুরু থেকেই জমির খাজনাও পরিশোধ করছেন। কিন্তু যখনই জমির দখলে যেতে চেয়েছেন, তখনই বাধা দিয়েছে তাড়ল গ্রামের একটি পক্ষ। জমির দখল না পাওয়ার দুঃখ নিয়েই ২০০৯ সালে মারা যান শাহ আবদুল করিম। এরপর নানাভাবে জমির দখল পাওয়ার চেষ্টা করেন তাঁর ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল। এলাকার একটি পক্ষের বাধার কারণে তিনিও দখল পাননি। শেষে তিনি জমির দখল পেতে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন দেন।
নতুন করে শাহ আবদুল করিমের পরিচয় দেওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে তো বটেই, ভারতসহ সারা বিশ্বের বাঙালিদের কাছে তিনি একজন বাউলসম্রাট হিসেবে সমাদৃত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সংসারী হলেও ছিলেন প্রচণ্ড সংসারবিমুখ মানুষ। সঙ্গীত বিশেষ করে বাউলঘরানার সঙ্গীতসাধনাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হলেও তার লেখা গানের ভাবার্থ তাকে দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছে। তার সুর বাংলার লোকগানের জগতে এক অসাধারণ সংযোজন। তার গান আজ বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বসঙ্গীতের আসরে ঠাঁই করে নিয়েছে।
সারাজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গেই বসবাস করেছেন কিন্তু তাতে সঙ্গীতের প্রতি কখনো তার মনোযোগ কমেনি, বরং বিদ্রোহী কবি নজরুলের ভাষায়, দারিদ্র্য তাকে যিশুখ্রিষ্টের সম্মানই যেন দান করেছিল। তার গান গেয়ে, তার গানের অ্যালবাম বাজারজাত করে অনেকে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হলেও তাতে শাহ আবদুল করিমের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তার পাশাপাশি নিজেকে নিরন্তর সঙ্গীতের সাধনায় নিয়োজিত রেখে কপর্দকহীন অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া জমি, যার খাজনা-ট্যাঙ নিয়মিত পরিশোধ করেছেন সে জমি নিজের বলে দেখে যেতে পারেননি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে বাঙালির অশেষ ঋণ, যা শোধবার নয়। বাঙালির যা কিছু সৃজনশীল, যা কিছু সৃষ্টিশীল, যা কিছু কল্যাণকর তার অধিকাংশই তার প্রেরণা ও তার দ্বারা প্রাপ্ত। তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও সাধারণ মানুষের লাঞ্ছনাা-বঞ্চনার কথা অকৃত্রিম দরদ দিয়ে তুলে ধরেছেন। তার বিখ্যাত কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’ তে তিনি লিখেছেন, রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি ‘। এ এক চিরকালীন সমাজ বাস্তবতার করুণ চিত্র। যাদের ভুরি ভুরি আছে তারাই ছলেবলে কৌশলে গরিবের সম্পদ লুট করে নেয়। এখনো সমাজে ‘বাবু’রা বিদ্যমান এবং তাদের লোভ-লালসার বলি হতে হচ্ছে হাজার-লক্ষ উপেনকে।
শাহ আবদুল করিমকে উপেনের ভাগ্য বরণ করেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। একজন জেনারেলের সরকার এই সঙ্গীতসাধকের জন্য যে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছিল স্বাধীন দেশের সরকারের প্রায় ৫০ বছর লেগে গেল তার সে জমি তার পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে।
শাহ আবদুল করিমকে সরকারের দেওয়া জমির খবর আমরা আগে শুনিনি। জানি না যারা তার শিষ্য ছিলেন, যারা তার কাছ থেকে সঙ্গীত দীক্ষা নিয়েছেন, যারা তাকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন, গবেষণা করছেন এবং যারা তার গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন তারা জানতেন কি না? জানলেও সে বিষয়ে তাকে কোনোরূপ সহযোগিতা করেছিলেন কি না?
জমির বিষয়টি নিয়ে গত রোববার প্রথম আলোয় ‘শাহ আবদুল করিমকে দেওয়া জমি ৫৭ বছরেও পায়নি পরিবার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে প্রথম জানলাম। সোমবার বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোতে একটি সম্পাদকীয়ও ছাপা হয়।এরপর দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান মামুন মঙ্গলবার উপজেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে উজানধল গ্রামে যান। এরপর শাহ আবদুল করিমের একমাত্র ছেলে শাহ নূর জালালসহ অন্যদের নিয়ে দিনভর জমি মাপজোখ করেন। বিকেলে তাঁকে জমি বুঝিয়ে দিয়ে সেখানে একটি সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয়।
এর জন্য প্রশাসন তথা সরকারের পদক্ষেপে স্বাগত জানাতে হয়। আমার ধারণা শাহ আবদুল করিমের ওপর এই অন্যায় আচরণের কথা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জানতেন না। কেউ তার গোচরে আনেননি বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু এই বাউলসম্রাটকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। শুধু তাই নয় বাবার মতো শেখ হাসিনাও শাহ আবদুল করিমের ভক্ত। সংবাদ প্রকাশের পর নিশ্চয়ই তার নির্দেশেই প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে এসেছে। ঘটনাটি কি এখানেই শেষ হবে? যারা এতদিন শাহ আবদুল করিমের পরিবারকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তাদের কি আইনের আওতায় আনা হবে না? এই অন্যায় আচরণের বিচার হবে না? এরপরও কি বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে? উপেনরা জমিহারা হবে আর ‘বাবু’রা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে?
লেখক : কবি ও সাংবাদিক