স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্য অবস্থা

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য | বৃহস্পতিবার , ২৭ মে, ২০২১ at ৯:২৬ অপরাহ্ণ

বিল গেটস্‌ বলেছিলেন, দরিদ্র হয়ে জন্মগ্রহণ করা অপরাধ নয়, বরং দরিদ্র হয়ে মৃত্যুবরণ করা অপরাধ। বিখ্যাত ও ধনী ব্যক্তিরা যখন এমন কথা বলে তখন এ কথার মধ্যে একটি মর্মার্থ আছে বলে মনে করা হয়। এখানে তিনি হয়তো কর্মপ্রচেষ্টার অলসতাকে বুঝিয়েছেন। যে ব্যক্তি পূর্ণকালীণ সময়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্য প্রচেষ্টা চালায় না ঐ ব্যক্তির ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। দরিদ্র অবস্থাও তাঁর ঘুচাবে না। এ কথা অবশ্যই সত্য। বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলা যায়, এ দেশের মানুষের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (গচঈ) অধিক। মানুষ নির্দিষ্ট সময়ে যা আয় করে সেই আয়ের অধিকাংশ ভোগ করে। ফলে প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণে সঞ্চয়ের পরিমাণ তুলনামূলক কম। কিন্তু ভোগের আনুপাতিক হারের তুলনায় যদি আয় বেশি হয় তবে অর্থনীতির নিয়ম অনুসারে সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। কাজেই বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষের আয়ের পরিমাণ ভোগের অনুপাতিক হারে কম বলে সঞ্চয় কম হয়। এ কারণে বাংলাদেশের মানুষ দরিদ্র।
অবশ্য বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্ক্স বলেছেন অন্য কথা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের ইতিহাসকে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তবে দেখা যাবে সব ধরনের কর্মকাণ্ডে রয়েছে স্বার্থের ইতিহাস। আর পুরো অর্থনীতি জুড়ে রয়েছে শ্রেণি স্বার্থের ইতিহাস। অর্থনীতিতে দুইটি শ্রেণি বিদ্যমান। একশ্রেণি হয় শোষক আর এক শ্রেণি হয় শোষিত। তবে এর মধ্যে শোষক শ্রেণি হয় সংখ্যায় কম আর শোষিত শ্রেণি হয় সংখ্যায় বেশি। যেহেতু শোষক শ্রেণি ছলে, বলে, কৌশলে শোষিত শ্রেণিকে শোষণ করে সেহেতু শোষিত শ্রেণি দরিদ্র। অন্যথায় বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র হবার কোন কারণ নেই। মার্ক্স আরো বলেন, এ পৃথিবীতে মানব সন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে তখন শুধুমাত্র পেট নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না, সাথে দুইটি হাত নিয়েও জন্মগ্রহণ করে। এ মানব সন্তান কালক্রমে বড় হয়ে ঐ দুইটি হাত দিয়ে কাজ করে। আর তা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অতএব শ্রেণিস্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ মানুষকে খেয়ে না খেয়ে দরিদ্র অবস্থায় দিন যাপন করতে হচ্ছে।
কিন্তু গণতন্ত্রের কাঠামো এরূপ যে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে মেনে নেয়। যেহেতু গণতন্ত্রের কাঠামোকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় সেহেতু বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা দারিদ্র্যকে স্বীকার করে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। অতএব গণতন্ত্রকে মেনে নিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা করলে সেই ক্ষেত্রে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য মেনে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়। এই অবস্থায় মানবতাধর্মী রাষ্ট্রপ্রধানেরা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য নিরসন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই ক্ষেত্রে দারিদ্র্যের হার কমলেও একেবারে তা শূন্যের কোটায় আসেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোতে জাতীয় আয়ের পরিমাণ অধিক হলেও ঐ সকল দেশেও দারিদ্র্যের পরিমাণ শূন্যের কোটায় আসেনি। এ কারণে বিল ক্লিনটন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তিনি সেই দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের দারিদ্র্য নির্মূল ব্যবস্থার পদ্ধতি প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন। এসব দেশে এখনও প্রচুর গৃহহীন নর-নারী রয়েছে যারা রেলস্টেশনে বা রেলে বা উন্মুক্ত জায়গায় বসবাস করে। এসব দেশসমূহে দারিদ্র্য নিরসনের জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারপরও উন্নত দেশসমূহে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় আসেনি। আবার কার্ল মাক্সের তত্ত্বকে তাঁরা স্বীকারও করে না। বরং এর বিপরীতে উন্নত দেশগুলো দরিদ্র শ্রেণির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন, বেকার ভাতা, দরিদ্র ভাতা, পোষ্য ভাতা, বিনামূল্যে স্বাস্থ্য চিকিৎসা সুবিধা ইত্যাদি। ইহার অর্থ হলো যে, অর্থনীতিতে সুবিধাবঞ্চিত লোকেরা যাতে কিছুটা সুবিধা পায় তার চেষ্টা করা। কিন্তু বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলো যে পরিমান দরিদ্র্যদের সুবিধা প্রদাণ করে তার চেয়ে বেশি সুবিধা প্রদান করে ধনীদের। ফলে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ধনী ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্বের মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ রয়েছে বিভিন্ন দেশের ধনীদের হাতে।
বাংলাদেশ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে অনেক ধরনের রসিকতা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারতো বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করেছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশকে সহায়তা নিয়েই টিকে থাকতে হবে। তখন বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় নব্বই শতাংশ। সেই চরম দারিদ্র্য ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এসে দেখা যায়, এ সময়ে বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। দারিদ্র্যের ভেতর আর একটি অবস্থা হচ্ছে চরম দারিদ্র্য। চরম দারিদ্র্য হচ্ছে এমন এক অবস্থা যেখানে একটি পরিবার সকালে নিশ্চয়তা দিতে পারে না দুপুরে খাবে কিনা, আর দুপুরে নিশ্চয়তা দিতে পারে না রাত্রে খাবে কিনা। সুতরাং বলা যায়, দারিদ্র্যের একটি অংশ হচ্ছে চরম দারিদ্র্য। ২০০০ সালকে যদি আমরা ভিত্তি বছর হিসেবে মনে করি তবে দেখা যায়, এ সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৪৮.৯ শতাংশ। এর মধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ৩৪.৩ শতাংশ। ২০০৫ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ২৫.১ শতাংশ। ২০১০ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ৩১.৫ শতাংশ হয়। যার মধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ১৭.৬ শতাংশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। এর মধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ১২.৯ শতাংশ। আবার ২০১৭ সালে এদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৩.১ শতাংশ। তৎমধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ১২.১ শতাংশ। ২০১৮ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২১.৮ শতাংশ। তার মধ্যে চরম দারিদ্র্যের হার ছিল ১১.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যানুসারে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। তৎমধ্যে চরম দারিদ্র্য ছিল ১০.৫ শতাংশ।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেতে শুরু করে। এ সময় থেকে প্রতিটি সরকার গ্রামাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে জোর দিতে থাকে। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সব ধরনের সেবা পৌঁছে যেতে থাকে। বিশেষ করে নারীদের উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে বেশি। অপরপক্ষে বাংলাদেশের ন্যায় একটি উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী সেখানে নারীর উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপগুলো এদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করেছে অধিক। তাছাড়া সরকার মেয়েদের যে উপবৃত্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সেই উপবৃত্তি নারী শিক্ষার হারকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে মোট কর্মক্ষম জনশক্তির মধ্যে যুক্ত হয়েছে নারী। একই সাথে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিও একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার উপার্জনকে যেমন বৃদ্ধি করেছে তেমনি এ দেশের দারিদ্র্যকে হ্রাস করেছে। একই সাথে এ দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের কারণে এবং অধিক নারী শিক্ষিত হওয়ার কারণে গ্রাম-গঞ্জের বিপুলসংখ্যক নারী শহরে বা শহরতলীতে অবস্থিত পোশাক শিল্পে নিয়োজিত হতে পেরেছে। পোশাক শিল্পে নিয়োজিত নারীদের পারিশ্রমিক কম হলেও তারা নিজেদের অনেকাংশে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে। ফলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। একদিকে বিপুল পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, আর অন্যদিকে পোশাক শিল্পে নারীদের কর্মসংস্থান এবং পোশাক শিল্পে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, এদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি হ্রাসে সহায়তা করেছে। এখানে একটি কথা না বললেই নয়। বিদেশে প্রেরিত জনশক্তি তাদের উপার্জিত পারিশ্রমিক দেশে পাঠাতো অনেকাংশে হুন্ডির মাধ্যমে। বর্তমান সরকার সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করে এদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তৎমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদেরকে সরকার একটি নির্দিষ্ট হারে প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করে। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশীরা আর হুন্ডির মাধ্যমে তাদের উপার্জিত অর্থ প্রেরণ না করে ব্যাংকের মাধ্যমে তথা বৈধপথে প্রেরণ করতে থাকে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রেখেছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ

পূর্ববর্তী নিবন্ধজনতার অকৃত্রিম বন্ধু অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল