এমপি পদও হারাতে পারেন মুরাদ

মন্ত্রিত্বের পর খোয়ালেন দলীয় পদ ।। পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি ।। থানায় অভিযোগ ছাত্রলীগ কর্মীর

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

দিনভর আলোচনায় ডা. মুরাদ হাসান। হারালেন মন্ত্রিত্ব। খোয়ালেন দলীয় পদ। এখন সংসদ সদস্যের পদও হারানোর ঝুঁকিতে। অডিও কেলেঙ্কারিতে প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে আভাস দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দলীয় কার্যালয়ে এক ‘জরুরি’ সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ জানান।
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হলে সংসদ সদস্য পদও হারাতে পারেন ডা. মুরাদ হাসান। এদিকে গতকাল দুপুরে ইমেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন মুরাদ হাসান। সেখানে তিনি লেখেন, প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে ‘ব্যক্তিগত কারণে স্বেচ্ছায়’ তিনি পদত্যাগ করতে চান। নিয়ম অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদত্যাগপত্র দেওয়ার কথা থাকলেও গতকাল বেলা সোয়া ১২টার পর ইমেইলে মুরাদের পাঠানো পদত্যাগপত্র তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায়। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন তখন বলেছিলেন, ওই পদত্যাগপত্র তারা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু ঘণ্টা দুই পর জানা যায়, ভুল থাকায় তা সংশোধন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ‘হার্ড কপি’ আকারে তা আবার জমা দিতে বলেছে। প্রতিমন্ত্রীর পার্সোনাল অফিসার (পিও) বিকালে সেই সংশোধিত পদত্যাগপত্র পৌঁছে দেন। মুরাদ হাসানের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গতকাল রাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এই পদত্যাগ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানা গেছে। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দলীয় ভাবমূর্তি বিনষ্ট, অগঠনতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগে’ মুরাদ হাসানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত গতকালই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠানোর কথা। জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদকের পদে হারালেও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থাকবে মুরাদের। সে বিষয়ে কেবল কেন্দ্রীয় কমিটিই সিদ্ধান্ত নিতে পরে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক হলে তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে ‘নারীবিদ্বেষী’ মন্তব্য করে সমপ্রতি বিএনপি নেতাদের সমালোচনায় পড়েন মুরাদ হাসান। এরপর একটি টেলিফোন আলাপের অডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে অশালীন ভাষায় কথা বলতে এবং হুমকি দিতে শোনা যায় এক ব্যক্তিকে। বলা হচ্ছে, ওই ব্যক্তি মুরাদ হাসান। এ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে সোমবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, মুরাদকে পদত্যাগ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান তালুকদারের ছেলে মুরাদ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী, মেস্টা ও তিতপল্যা) সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মুরাদ। ওই বছর মে মাসে তাকে স্বাস্থ্য থেকে সরিয়ে তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের খবরে তার নিজের নির্বাচনী এলাকা জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে আনন্দ মিছিল করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে তার কুশপুতুলও পোড়ানো হয়।
মুরাদের প্রাথমিক সদস্যপদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হবে। দলের দায়িত্বশীল পদে থাকা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে, তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন, তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
দল থেকে বহিষ্কার হলে অনিশ্চয়তায় পড়বে মুরাদের সংসদ সদস্য পদ। এ বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন স্পিকার।
মুরাদের পদত্যাগপত্রেও ভুল
মুরাদ হাসান ইমেইল করে যে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন, সেখানেও বেরিয়েছে ভুল। পদত্যাগপত্রে মুরাদ লিখেছিলেন, তাকে তথ্য ও সমপ্রচার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ২০২১ সালের ১৯ মে। যদিও ওই দায়িত্বে তিনি এসেছিলেন ২০১৯ সালের ১৯ মে। ওই ভুলের কারণে এবং ইমেইলে পাঠানোয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তা ফেরত পাঠায়। পরে ভুল সংশোধন করে ‘হার্ড কপি’ আকারে দেওয়া হলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তা গ্রহণ করে।
হারাতে পারেন এমপি পদও
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার হলে সংসদ সদস্য পদও হারাতে পারেন মুরাদ হাসান। বিষয়টি নির্ধারিত হবে আওয়ামী লীগের আগামী কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়। সংবিধান অনুযায়ী কোনো দল থেকে নির্বাচিত কোনো সংসদ সদস্য ওই দলের প্রাথমিক সদস্য পদ হারালে তিনি আর সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারেন না। অথবা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে এবং তিনি বিচারিক আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়।
কোনো ব্যক্তি যে দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেই দল থেকে বাদ পড়লে তার সদস্য পদ থাকে কিনা জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, দল থেকে বহিষ্কার হলে সংসদ সদস্য না থাকারই কথা। যে দল থেকে যিনি নির্বাচিত হন, যে পার্টিকে তিনি বিলং করেন, সে পার্টি থেকে বহিষ্কার হলে সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদ থাকে না। সংসদ সদস্যরা যদি এই দল, ওই দল করে তাহলে তো সরকারের স্থিতিশীলতা থাকে না। কারণ সংসদ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করেই সরকার গঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। কোনো সিদ্ধান্তে আসতে হলে সময় লাগবে। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভা ছাড়া তো কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেটা উনার বিষয়। আর সাধারণত কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে এবং তাকে বাদ দিতে হলে কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এর আগে ধর্মীয় বিষয়ে এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদ এবং দলের প্রাথমিক সদস্য থেকেও বাদ দেওয়া হয় তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীকে। তাকে কারাগারেও যেতে হয়। দল থেকে বহিষ্কারের পর ২০১৫ সালে লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদও চলে যায়। আবার কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হলে এবং তিনি দুই বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হলে সংবিধান অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়।
জানুয়ারিতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলকে কুয়েতের একটি আদালত চার বছরের সাজা দেয়। এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি ওই আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়।
অভিযোগ পেলে জিজ্ঞাসাবাদ : ডিবি
অডিও কেলেঙ্কারির সঙ্গে বর্ণ ও নারী বিদ্বেষী বক্তব্যের অভিযোগের সমালোচনার মুখে থাকলেও এখনই মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপে যাচ্ছে না গোয়েন্দা পুলিশ। মুরাদকে নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) এ কে এম হাফিজ আক্তারকে প্রশ্ন করলে তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, কেউ যদি কোনো অভিযোগ দেন বা মামলা হয়, তাহলে আমরা দেখব। না হলে আমরা এটা নিয়ে এ মুহূর্তে ভাবছি না।
মুরাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে থানায় ঢাবির ছাত্রলীগ কর্মী
মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করতে ঢাকার শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়ে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ কর্মী। তার অভিযোগ, মুরাদ হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাচ্ছিল্য এবং রোকেয়া ও শামসুন নাহার হলের নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর শিক্ষার্থীদের মানহানি হয়েছে।
অভিযোগকারী জুলিয়াস সিজার তালুকদার বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাবেক জিএস। ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবেই তিনি নির্বাচনে জিতে জিএস হয়েছিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় গিয়ে তিনি ওই মামলার আবেদন করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সাজানো দপ্তরে বসা হলো না
১০ দিন আগে শুরু হয়েছিল প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর সাজানোর কাজ। সেই কাজ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগে বাধ্য হলেন মুরাদ হাসান। গতকাল তার দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, নতুন করে সাজানো হচ্ছে সবকিছু। কাজ প্রায় শেষের দিকে। ১০-১২ দিন আগে কক্ষটি নতুন করে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুরাদের মধ্যে পরিবর্তন টের পাচ্ছিলেন তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাই হানাদার মুক্ত দিবস আজ