শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার কেবলমাত্র ইট-পাথর ও লোহার অবকাঠামো নয়। বরং এটা চট্টগ্রামের আগামী প্রজন্মের স্বপ্নপূরণের ঠিকানা হবে বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি বলেন, এখানে প্রতি বছর এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাদের মেন্টররা ইনকিউবেট করবে এবং উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার জন্য বিশেষভাবে দেখাশুনা করবে। তাদেরকে ফ্রিল্যান্সার এবং এন্টারপ্রেনার বানানো হবে। গতকাল শনিবার সকালে নগরীর কালুরঘাটে বিএফআইডিসি রোড সংলগ্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশেনের এক দশমিক ৭১ একর জায়গায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার অ্যান্ড ইনকিবিউশেন সেন্টারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।
জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আইটি সেন্টারটি হবে ৩৬ হাজার বর্গফুটের ছয়তলা ভবনে। যেখানে স্টার্টআপদের জন্য একটা ফ্লোর থাকবে। এছাড়া প্লাগ অ্যান্ড প্লে অর্থাৎ যারা ফ্রিল্যান্সিং করে, তাদের জন্য ২৪ ঘণ্টা হাই স্পিড ইন্টারনেট থাকবে; যাতে তারা দেশে এবং বিদেশে অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসে প্লাগিং করেই কাজ করতে পারবে। এজন্য তাদের কোনো টাকা-পয়সা খরচ হবে না।
তিনি বলেন, সনদপত্র নির্ভর নয়, দক্ষতা নির্ভর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এ কারণেই ৬৪ জেলায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। প্রথম পর্যায়ে যে আট জেলায় শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার হচ্ছে তার মধ্যে প্রথম দফায় চট্টগ্রামে করছি। চট্টগ্রামে আরো ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটে ৯০ হাজার বর্গফুটে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক করছি এবং নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ছয় মাসের মধ্যেই এটা প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বোধনের অনুরোধ করব।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার প্রকল্পে পুরো ধারণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। প্রকল্পটি তার ব্রেইন চাইল্ড। প্রতিটি জেলায় জায়গা চেয়েছিলাম, সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতা ছাড়া এ জায়গা আমরা পেতাম না। ৬২ ও ৭২ সালেও এ জায়গাটি সরকারকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে এমপি-মন্ত্রীরা এখানে এসে প্রতিশ্রুতি দিলেও কাজ করেননি।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, চট্টগ্রামে যে বিশাল কর্মযজ্ঞগুলো হচ্ছে সেখানে স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান যেন হয় তার আবেদন রাখব সরকারের কাছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১২শ কোটি টাকায় হামিদচরে আন্তর্জাতিক মানের মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে। এখানে আমাদের ১২টি পরিবারের সন্তানকে যদি কাজ দিতে না পারি, তাহলে এই উন্নয়নের ভাগিদার বা উন্নয়নের সুবিধাভোগী এখানকার মানুষেরা হবে না। অনেক জায়গায় আমরা দেখেছি, চট্টগ্রাম বন্দরের আশেপাশে দেখেছি, যাদের জায়গা জমি নিয়ে বিশাল স্থাপনা, অবকাঠামো হয় তাদেরকে সুবিধাভোগীদের মধ্যে আমরা পাই না। সেটা নিশ্চিত করতে চাই।
তিনি আরো বলেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামের মানুষদের এখন এগিয়ে যাওয়ার সময়। কারণ শেখ হাসিনা এখানে সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন। খালেদা জিয়া শুধু মন্ত্রী দিয়েছেন, কিন্তু শেখ হাসিনা এখানে বিনিয়োগ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, সনাতনী চিন্তায় একেবারে শিশু বয়স থেকে আমাদের সন্তানদের ভর্তিযুদ্ধের নাম করে ভয়াবহ মেধা প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিচ্ছি। এ ভয়াবহ কারণে তাদের সৃজনশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে, আত্মকেন্দ্রিকতার সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ১০ বছর বয়সে কিসের মেধার পরিচয় দেবে সে? তখন তো শেখার কথা। ১৮ বছরের আগে পরিচয় দেওয়ার মতো মেধা তো সে অর্জনই করেনি। কিন্তু এমন একটা পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলাম বা হয়ে গেছে, যেটার কারণে আমাদের অনেক সন্তান দক্ষ শিক্ষার্থী হিসেবে পাশ হচ্ছে না। এটা জাতীয় বাস্তবতা।
‘ড্রপ আউট’ হওয়া শিক্ষার্থীরা সম্পদ মন্তব্য করে তিনি বলেন, পিছিয়ে পড়া ছাত্ররাই কিন্তু সাহস দেখিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু যারা এগিয়ে থাকে বাস্তবে তারা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিকও হয়। আমরা সবাইকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলে আমরা বালাম বই আর খাতুনগঞ্জে বসে বাণিজ্যের কথা শুনেছি। কিন্তু এভাবে করলে সে বাণিজ্য আগাবে না। আজকে এই অঞ্চলের মধ্যে যে স্থবিরতা তার কারণ সনাতন চিন্তা এবং প্রযুক্তির ব্যবহার না করে ব্যবসা করা। শুধু এলসি আনব, এলসি করে এনে দুটো মার্জিন (কমিশন) খেয়ে ব্যবসা করব-এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, আমরা মনে করি সনাতন পদ্ধতিকে ফেলে প্রযুক্তির শিক্ষা নিতে হবে। তাহলে একটা সম্ভাবনা আছে এগিয়ে যাওয়ার।
তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। তাদের জেন্টলম্যান মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সনদ নেওয়ার পরে চাকরি করার এবং পাওয়ার যে মানসিকতা এবং চাকরি পাওয়া যে আমরা অধিকার মনে করি সেটার পরিবর্তন করতে হবে। বৈশ্বিক অর্থনীতির কারণে সেটার পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের অর্থনীতিতেও এই ধরনের লাখ লাখ দাপ্তরিক চাকরি দেওয়া যাবে না। শেখ হাসিনার সরকার যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। সেখানে আমাদের ঢুকে পড়তে হবে। নিজেদের উন্নত করতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।
নওফেল বলেন, শুধু কারিগরি নয়, ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি নেওয়ার পর যে কোনো ট্রেডের উপর প্রশিক্ষণ নেয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট হিসেবে আরো পাঁচটা ছেলেকে নিয়ে সেবা দেওয়ার মাধ্যমে আয়ের উৎস সৃষ্টি করতে পারব। কিন্তু গ্রাজুয়েট হওয়ার পর আপনি যদি মনে করেন, আমি কেন মিস্ত্রির পেছনে ঘুরব, কিসের জন্য আমি নিজ থেকে এটা করতে যাব, আমি তো ইউনিভার্সিটির সনদধারী, তাহলে হবে না। চাকরি দিতে হবে, বেতন দিতে হবে, এটা নিয়ে থাকবেন, এটার পেছন পেছন ঘুরবেন, তাহলে আপনার জীবনও নষ্ট হবে, আপনার পরিবারের স্বপ্নও ভাঙবে। তাই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।
তিনি বলেন, যে টানেল হচ্ছে সেখানে গিয়ে দেখবেন অনেক চীনা শ্রমিক ওয়েল্ডিং করছে এবং তাদের বেতন ৫০ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে। কিন্তু আমরা ওয়েল্ডিং শিখব না। গ্রাজুয়েট হয়েছি, তাই আমাদের মানসিকতা শার্ট-প্যান্ট পরে অফিসে চাকরি করব।
চসিক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের আইটিতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করে আইটি ইন্ডাস্ট্রিতেও এখন চট্টগ্রামবাসীর অবদান রাখার ক্ষেত্র প্রস্তুত হলো। এই আইটি ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে আইটি খাতে চট্টগ্রামের যুব সমাজের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মোস্তফা কামাল, চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক, বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের পরিচালক এ এম এম শফিকুর ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আ স ম জামশেদ খন্দকার, চন্দগাঁও ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ প্রমুখ।
আ স ম জামশেদ খন্দকার ড্রপআউট করা শিক্ষার্থীদের নিয়েও আইসিটি সেন্টারের মতো প্রশিক্ষণ প্রকল্প করার আহ্বান জানান।
কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে ভিত্তি প্রস্তর করতে পিছিয়ে গেছে। নতুন উদ্যোক্তা ও ব্যবসা পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখেবে আইটি সেন্টার।
মো. মোস্তফা কামাল বলেন, প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ হবে। এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবেন।
শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার নির্মাণে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। বিএফআইডিসি রোডে সিটি কর্পোরেশনের ১১ দশমিক ৫৫১ জায়গা রয়েছে। পুরো জায়গায় ২০২১ সালের জুনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ হাই-টেক পার্ক গড়ে তোলা হবে। এ লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ সিটি কর্পোরেশন এবং বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। চুক্তির আওতাভুক্ত জায়গার মধ্যেই সেন্টারটি নির্মাণ করা হচ্ছে। গত আগস্টে এ সেন্টার নির্মাণে সিটি কর্পোরেশন থেকে এক দশমিক ৭১ একর জায়গা বুঝে নেয় হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।