ই-কমার্স বলতে আমরা বুঝে থাকি ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ইলেক্ট্রনিক ডাটা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সকল প্রকারের ভৌত এবং ডিজিটাল পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয় করাকে। বাংলাদেশে এখন অনেকেই অনলাইনে কেনাকাটা সারছেন। করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যবিধির কঠোরতায় সেটা আরও বেড়ে যায়। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক্স পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা আগেই ছিল। অনেকে আছেন কাঁচাবাজারও সারছেন অনলাইনে। কোরবানি ঈদের সময় আমরা দেখেছি, যাঁরা এত দিন গরুর হাটে গরু কিনতে যেতেন এবং শিং, দাঁত ইত্যাদি দেখে গরু কিনতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই অনলাইনে গরু দেখে ও ঘরে বসে পছন্দ করে কিনছিলেন খামারে থাকা গরু। করোনাকালে যাঁরা একবার অনলাইনের মাধ্যমে কোনো ঝামেলা ছাড়া ঘরে বসে তাঁদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি পেয়েছেন, তাঁরা আবার কেনার জন্য অনলাইন মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছেন। অনলাইনে কেনা ও লেনদেনের যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে, তার একটি অংশ ভবিষ্যতেও থাকবে। তথ্যমতে বর্তমানে নতুন পুরাতন মিলিয়ে এরকম অনলাইন উদ্যোক্তার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১২০০ এর মতো। শুনলে অবাক লাগে অনলাইনে বছরে পণ্য বিক্রির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকার মতো। সত্যি বলতে বাংলাদেশে এ এক বিশাল বাজার ই-কমার্সের। ই-কমার্স খাতে লেনদেন নাকি প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু ভালো উদ্যোক্তাদের এ ধরনের উদ্যোগে খারাপ দৃষ্টি পড়ে ও ঝামেলা পাকায় এক শ্রেনীর অর্থলোভী মানুষ।
অনলাইনে কেনাকাটার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা এখন প্রতারণা, যা আমি শুরুতেই একটা উদাহরণ মাত্র দিয়েছিলাম। প্রান্তিক পর্যায়ের ভোক্তা ও ক্রেতাদের ঠকাচ্ছেন বিভিন্নভাবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করছেন না। অনলাইনে যা দিবে বলছে, তা পাঠাচ্ছে না অর্থাৎ অর্ডার করা পণ্যের বিপরীতে অনেক সময় অন্য পণ্য, কমমূল্যের পণ্য ও মানহীন পণ্যও নাকি সরবরাহ করা। টাকা পাওয়ার পর কাস্টমারের ফোন ব্লক করে দেওয়া। কোম্পানির ফেসবুক পেজে মেসেজ দিলে সেগুলো সিন করেও উত্তর না দেওয়া ইত্যাদি। এরকম একটি উদাহরণ দেওয়া যায় সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ইভ্যালিকে নিয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ইভ্যালি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে হোটেলে একটি রুম বুক করেছিলেন। এ জন্য তিনি প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা দেন। ইভ্যালি তাঁকে একটি কোড নম্বর দেয়। এক মাস পর ইভ্যালি থেকে কল করে তাঁকে জানানো হয়, হোটেলটিতে সেই রুম বুক করার অফারটি আর নেই। অথচ অ্যাপে লেখা দেখাচ্ছিল সেখানে রুম আছে। এরপর তিনি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য দুই মাস ইভ্যালির অফিস ঘুরেও টাকা ফেরত পাননি। ক্ষুব্ধ ছাত্র বলেন, দুই মাস ধরে ইভ্যালিতে কল করছি; কিন্তু আমার কল রিসিভ করে না। তদন্তে উঠে আসে এ রকম লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে অভিনব কায়দায় লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে ফেলে ভয়ানক প্রতারণার আশ্রয় নেয় ইভ্যালি। যেমনঃ কোনো ক্রেতা নগদ ছয়হাজার পাঁচশত টাকা পরিশোধ করে গিফট কার্ড কিনলে তার ইভ্যালি অ্যাকাউন্টে দশহাজার টাকার ব্যালেন্স জমা হয়। ওই ব্যালেন্স নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করে কোনো পণ্য ক্রয় না করলে তা বাতিল হয়ে যায়।
আরেকটি ভয়াবহ প্রতারণা নাম হচ্ছে ক্যাশ ব্যাক অফার। বিভিন্ন অনলাইনে বিজ্ঞাপনে দেখি কোম্পানিগুলো বিভিন্ন পন্যে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেয়। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। ছোট করে একটা ষ্টার দিয়ে লিখে দেয় প্রথম পাঁচজনের জন্য প্রযোজ্য। আমরা শর্ত না দেখেই দ্রুত অনলাইনে টাকা দিয়ে দিই। একটুও চিন্তা করি না আমি প্রথম পাঁচজনে আছি কিনা? এবার অপেক্ষার পালা। পাঁচজনকে হয়তো ঠিকই দিয়েছেন, কিন‘ পাঁচহাজার জনের টাকা উনার একাউন্টে। এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে যার একটি বৃহৎ অংশ মানি লন্ডারিং হওয়ার সুযোগ থেকে যায়।
এ বিষয়ে জ্ঞান কম থাকায় ব্যাপার গুলো পরিস্কার হওয়ার জন্য একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংকার বন্ধুর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলাম। সব শোনার পর মনে হলো, সব কিছু কন্ট্রোল করার আইন থাকলেও আইন গুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। ব্যাংকিং সিস্টেমের ফাঁকফোঁকার গুলো খুঁজে নিয়ে লেনদেন করে যাতে সমস্য সৃষ্টি না হয়। যেমনঃ কোন ব্যাংক হিসেবে একসাথে পাঁচলাখ টাকার বেশী জমা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকে অবহিত করার প্রথা চালু আছে। ধরুন আপনি আট লাখ টাকা জমা করবেন। সেখানে চারলাখ করে দুইবার জমা দিলে সমস্যা নেই। এ ধরণের ফাঁকগুলোর সুযোগ নেয় মুলত এ প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কোন একসময় এগুলো অডিটে ধরা পড়লেও ম্যানেজ করে ব্যবসা পরিচালনা করে যায় নির্দ্বিধায়। আমরা সবাই জানি ডেসটিনি বন্ধ হলেও প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকের কেউই এ পর্যন্ত কোন টাকা ফেরত পাননি। ডেসটিনির আদলে পরবর্তী সময়ে যুবক, ইউনি পে টু সহ একের পর এক কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং গ্রাহকের কোটি কোটি আত্মসাত করে উধাও হয়ে যায়। তবুও থেমে থাকেনি এই পদ্ধতিতে প্রতারণা। এখন বদলেছে প্রতারণার ধরণ। এখন তা করা হচ্ছে ডিজিটালি। ই-কমার্স কেলেঙ্কারির সব কিছুই হয়েছে প্রকাশ্যে, ডিজিটাল মাধ্যমে। বিভিন্ন স্কিমে টাকা বিনিয়োগ করে অর্থ আত্মসাৎ-এর ব্যাপারও উঠে আসে। অতি সম্প্রতি রিং আইডি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ও নাম দেখা যায়। আমরা জানলাম রিংআইডি সামাজিক যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম হলেও এর মাধ্যমে নানা ধরনের সেবা দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ভোক্তা পর্যায়ের দিক বিবেচনা থেকে আমার মনে হলো, নতুন ব্যবসা পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কোনরূপ মধ্যস্বত্বভোগীর সাহায্য ছাড়াই আপনি আপনার কাঙ্খিত জিনিষ পেয়ে যাবেন। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে, আমাদের দেশে ই-কমার্সের বাজার দ্রুত বর্ধনশীল এবং ভোক্তাদের বড় অংশ মধ্যবিত্তশ্রেণি। বর্ধিষ্ণু নগরায়ন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামীতে দেশের এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ই-কমার্স কর্মকান্ডের মূল চালিকাশক্তি হবে। কিন্তু এটার পরিচালনা বিষয়ক আলাদা কোনো আইন দেশে প্রচলিত নেই। তবে বিদ্যমান দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইন ২০০৯ অনুযায়ী অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পর সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ’ ও ‘প্রতারণা’ বলে বিবেচিত। আমার দৃষ্টিতে বর্তমানে আমাদের দেশে এ খাতে মূলত যে চ্যালেঞ্জ গুলো আছে হলোঃ ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা না থাকা, আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা, আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশের অভাব। বর্তমানে যা বিদ্যমান আছে তাতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। আপনি অনলাইনে প্রতারিত হলে সংশ্লিষ্ট সাইট বা গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগটি লিখিত আকারে ক্রয়ের রশিদসহ যাবতীয় তথ্য সংযুক্ত করে ভোক্তা অধিকার কার্যালয়ে ফ্যাঙ বা ই-মেইলে দিতে হবে। এতে কতটুকু কাজ হয় আমার জানা নেই। তবে অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা এড়াতে আমার মতে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরী। যেমন, কম দামে লোভনীয় অফারের ব্যাপার গুলো যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা। অগ্রিম টাকা দিয়ে না কিনে, পাওয়ার পর জিনিষ পছন্দ হলে ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য গ্রহণ। ফেসবুকে কেনাকাটার পেজ গুলোর কাস্টমারের রিভিউ দেখে কেনা। এক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য বড় প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজ বা গ্রুপে পণ্য কেনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
বর্তমানে ইভ্যালির মত শতশত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ও প্রতিদিন বানানো হাজারো ফেসবুক পেজে লোভনীয় অফারের নামে এরকম হাজারো গ্রাহক প্রতিনিয়ত ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে। এতে করে করোনাকালীন সময়ে অনলাইনের উপর নির্ভর করা ভোক্তারা অনলাইনে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে দিন দিন। ভাল ই-কমার্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও আজ প্রশ্নের সম্মুখীন এসব ভূঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের জন্য; যা ভবিষ্যতে ই-কমার্স থেকে বিমুখ করে দিবে লাখ লাখ গ্রাহককে। আমরা কয়েকজনকে হয়তো আইনের আওতায় আনলাম কিন্তু ভোক্তার টাকা ফেরত দিতে না পারলে, প্রতারণা বন্ধ না হলে তাতে কি লাভ হলো? তাই ভোক্তার অধিকার রক্ষার্থে, কর্তৃপক্ষের উচিৎ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কঠোর আইন তৈরী করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগে এগিয়ে আসা।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়