হানাদার বাহিনীর বর্বরতার প্রতিশোধ নিতেই মুক্তিযুদ্ধে যান বিরণ চন্দ্র দে

পংকজ দস্তিদার | মঙ্গলবার , ১২ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

ঐতিহাসিক ৭ জুন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষিত ৬ দফা দিবস। ১৯৬৬ সালের এ দিনটি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও নেতৃত্বে বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের মাইলফলক হিসেবে জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সেই ঐতিহাসিক দিনটি কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা বিরণ চন্দ্র দে এর মৃত্যুদিবস। ২০১৭ সালের এ দিনে তিনি স্ত্রী-পুত্র কন্যা ও সহযোদ্ধাদের শোকসাগরে ভাসিয়ে অনন্তলোকে ফিরে যান। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। বিরণ চন্দ্র দে এর জন্ম চকরিয়া উপজেলার বরইতলী গ্রামে ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। পিতা রমনী মোহন দে ও মাতা বুষ্টু বালা দে এর ঘরে তারা ছিলেন তিন ভাই তিন বোন। বীরণ দে ছিলেন সর্বকনিষ্ট সন্তান। তার তিন পুত্র ও দুই কন্যা হলেন বিধান চন্দ্র দে, ছোটন কান্তি দে, মটন কান্তি দে, শিলা রানী দে ও চামেলী রানী দে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মার্চ মাস পর্যন্ত পূর্ববর্তী দেড় বছর আমি চকরিয়ার বরইতলী হাই স্কুলে শিক্ষকতায় ছিলাম। সেই সূত্রে বিরণ চন্দ্র দে এর সাথে পরিচয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ পরে বিরণ চন্দ্র দে এর সাথে আবার দেখা হলে তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন আমার বয়স ২২ বছর। এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে আমি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বাঙালি-নিধন ও নারী শিশুদের ওপর অত্যাচারের খবর পেয়ে প্রচণ্ড বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠি এবং বাড়ির সবাইকে নিয়ে গ্রামের পূর্বে অবস্থিত পাহাড়ে চলে যাই। হানাদাররা চারদিকের মানুষের ওপর নানাভাবে অন্যায় অত্যাচার, খুন, লুটপাট শুরু করে। কয়েকজন বন্ধুর মুখে শুনতে পেলাম সীমান্তের ওপারে ভারতে বাংলাদেশি যুবকদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমি শপথ নিলাম প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবো, হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে প্রয়োজনে জীবন বিসর্জন দেবো। আর দেরি না করে এপ্রিলের মাঝামাঝি ভারতে গিয়ে প্রথমে পারওয়া শরণার্থী ক্যাম্পে যাই। পরদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর দানদেব ক্যাম্পে, কচুছড়ি ক্যাম্পে ও জারুলছড়ি ক্যাম্পে একদিন করে অবস্থান করি। জারুলছড়ি ক্যাম্প থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী দেমাগ্রী ক্যান্টনমেন্টের একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ওখানে চার/পাঁচ দিন অবস্থান করার পর সেনাবাহিনী বললো এই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এপ্রিল মাসের শেষদিকে আরো বেশকিছু বাংলাদেশি যুবকের সাথে আমি প্রশিক্ষণ লাইনে দাঁড়াই। লাইনে দাঁড়ানোর পর ভারতের সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের সেনা কর্মকর্তাদের বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা ও যাচাই-বাছাইশেষে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণশেষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ অফিসার গঙ্গারাম ও অন্যান্য অফিসার আমাদের ৩০ জনের একটি গ্রুপকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ও পোষাক দিয়ে সীমান্তের এপারে পাঠিয়ে দেন। গ্রুপের কমান্ডার ছিলেন রহমান ভাই। তার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ায়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা বিরণ চন্দ্র দে বলেন, ভারতের দেমাগ্রী ক্যাম্পে ছিলেন মেজর বাজওয়া ও মেজর নন্দলাল সিং। বিরণ চন্দ্র দে মেজর বাজওয়ার নেতৃত্বে ২০ জনের গ্রুপ বাংলাদেশে ঢুকেন। তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাই খালের পাড়ে হরিনা বাজারে প্রথম অপারেশন করেন। তিনি বে
াটখাটো অপারেশন করি ভারতীয় সেনাদের সাথে মিলে। আমাদের সাথে আরো দুই গ্রুপের ২০ জনসহ মোট ৪০ জনের গ্রুপ গঠিত হয়। এই তিন গ্রুপের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর অশোকমিত্র কারবারী। এক পর্যায়ে গ্রুপ কমান্ডার দিদারুল আলমের গ্রুপসহ আমরা প্রায় ৬০ জনের গ্রুপ কাপ্তাই বরকলে অপারেশন করি। বরকল থেকে বান্দরবানের পাশ দিয়ে পটিয়া সেগুন বাগানে আসার সময় হঠাৎ পাকিস্তান হানাদাররা আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। তখন ভোর আনুমানিক ৬টা। হানাদার বাহিনী সাত রাউন্ড গুলি ছোড়ে। আমরা এ অতর্কিত হামলার পাল্টা কোন জবাব না দিয়ে সেগুন বাগানে ঢুকে অবস্থান করি একদিন। পরদিন শ্রীমাই খালের ওপর দিয়ে রাঙ্গুনিয়া পার হই। এর পরদিন খবর নিয়ে জানতে পারি ওখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ আছে। তখন আমরা সবাই সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ভাত-পানি খেয়ে একদিন অবস্থান করি। পরদিন আবার ওখান থেকে রাঙ্গুনিয়া রাজার হাটের পশ্চিমে চিপছড়ি উপজাতি পাড়ায় অবস্থান করি। তারপর ওখান থেকে শরফভাটা গিয়ে একটি লোকাল কমিটি (স্থানীয়দের নিয়ে) গঠন করি। ঐ কমিটির সহযোগিতায় আমরা রাঙ্গুনিয়া উদালবনিয়া বাজারে অপারেশন করি। পরে রাজারহাট ও রাঙ্গুনিয়া চা বাগানে অপারেশন চালানোর পর ওখান থেকে এয়ারফোর্সের কমান্ডার করিমের অনুরোধে আমাদের কোম্পানির কমান্ডার অশোকমিত্র কারবারী আমাকে এবং আরো তিনজনসহ নিয়ে মোট চারজনকে কমান্ডার করিমের সাথে অপারেশন করার জন্য পাঠান। আমার সাথে একজন সাধন মাস্টার ছিলেন, তার খুব জ্বর হওয়াতে আমরা তিনজন করিমের সাথে যাই। কমান্ডার করিমের নেতৃত্বে নোয়াপাড়ায় বড় বিদ্যুৎ পাওয়ার হাউস পিলার উড়িয়ে দেই। পরদিন আবার কমান্ডার করিম আমাদেরকে কোম্পানি কমান্ডার অশোকমিত্র কারবারীর কাছে খুব সম্মানের সাথে পৌঁছে দেন। এরপর আরো ছোটখাটো কয়েকটি অপারেশন করি। আমরা কাপ্তাই থাকা অবস্থায় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সারেন্ডারের ঘোষণা জানতে পারি। তখন সবাই কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে ভারতের সৈন্যদের হাতে আমাদের অস্ত্র, বোমা ও গোলাবারুদ জমা দেই। জমা দেওয়ার পর আমাদের একটি করে স্লিপ দেওয়া হয়। এই জমার স্লিপ নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে আমি এবং আমাদের গ্রুপের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা ১৫ দিন অবস্থান করে যার যার বাড়িতে চলে যাই। বাড়িতে পৌঁছুলে গ্রামের অনেক লোক আমাকে দেখতে আসে, খোঁজখবর নেয় এবং খুব সম্মান জানায়।’
বীরণ চন্দ্র দে আরো বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন পর তিনি জানতে পারেন যে চট্টগ্রামের ষোলশহর সিডিএ মার্কেটে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানীর সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। আরো কয়েকজন সহযোদ্ধাসহ তিনি সেখানে যান। তাদের বলা হলো যে ভারতে যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধ করেছেন তাদের কাগজপত্র তখনো আসেনি। এরপর বিরণ চন্দ্র দে তার কাছে থাকা অস্ত্র জমার স্লিপ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেন। ভারতে প্রশিক্ষণশেষে ইংরেজিতে লেখা ২২৯ নম্বর ক্রমিকের একটি পরিচয়পত্র তাকে দেওয়া হয়েছিল। সেটাও তিনি কর্তৃপক্ষের লোকদের দেখান। এরপর তাকে মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক আতাউল গণি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদপত্র প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় সরকার যেসব সনদ ও গেজেট (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ ও মন্ত্রণালয় সনদসহ) প্রকাশ করে তার সবগুলোই তিনি পেয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় তার এক পুত্র বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চট্টগ্রাম সদর দপ্তরে এবং আরেক পুত্র চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত আছেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধা বিরণ চন্দ্র দে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান না হলে এই দেশ কখনো স্বাধীন হতো না। আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মকভাবে নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম এবং দেশের স্বাধীনতা এনেছি। এর ফলে আজ বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে বিশ্বের বুকে স্বাধীন দেশ হিসেবে রক্তে লেখা লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃপ্তপদে এগিয়ে চলেছেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপমহাদেশের প্রথম মুসলিম গণিত বিশারদ ড. আতাউল হাকিম
পরবর্তী নিবন্ধঅনলাইনে কেনাকাটা ও লোভনীয় ফাঁদ : সাবধানতা জরুরি