অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বিস্মৃত আওয়ামী লীগ নেতা

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বুধবার , ১৯ জানুয়ারি, ২০২২ at ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ


অধ্যাপক মওলানা নুরুল ইসলাম রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, ট্রেডবডির নেতা এবং সমাজহিতৈষী ছিলেন। বিচিত্র কর্মে নিয়োজিত ছিলো তাঁর বৈচিত্রময় কর্মবহুল জীবন। তাঁর জীবন নানা দিকে বিকশিত হয়েছিলো, সবদিকেই তাঁর প্রতিভাকে কর্ষণ করেছিলেন তিনি, কোনো একটি দিকে বেশি বা কম জোর পড়ে নি। জীবনকে এভাবে নানাদিকে বিভক্ত করে নিক্তির মাপে কোনো একটি দিকে পাল্লা ঝুঁকে বা হেলে পড়েনি, এমনই পরিমিতি বোধে বাঁধা জীবন। মওলানার বিধাতা, যিনি তাঁর ভবিতব্য জানতেন, মওলানার দেহ সংস্থানের সময় সব উপাদান এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছিলেন যে, কোথাও কম বেশি হয়নি। তবে একটি ক্ষেত্রে বোধ হয় বিধাতারও পক্ষপাত ছিলো। সেটি হলো রাজনীতি; চট্টগ্রামের একটি বিখ্যাত মওলানার বংশে তাঁর জন্ম; কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কামিল পাস মওলানা ইসলাম ইচ্ছা করলে বংশানুক্রমিক পেশা অবলম্বন করে ধর্মবেত্তা হতে পারতেন। কিন্তু তা’ হন নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ইসলাম সাহেব অধ্যাপনা কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। সিটি কলেজকে তখন নাইট কলেজ বলা হতো। প্রথম দিকের শিক্ষক তিনি কলেজের; অধ্যাপনাকর্মে যদি আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়তেন, যেমন রেজাউল করিম সাহেব বা সাদেকুর রহমান সাহেব, তাহলে শিক্ষকতা পেশায় আরো একজন মহান শিক্ষাবিদের নাম সংযোজন হতো। তা না হলেও শিক্ষক হিসেবে তাঁর কম সুনাম ছিলো না।
ব্যবসা বাণিজ্যের জগতেও বিচরণ ছিলো প্রফেসর ইসলামের। তবে ব্যবসায়ী না হয়ে তিনি হয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের নেতা। সেজন্য ব্যবসা করে তিনি ধনী হন নি; তিনি বরং ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা, অভাব, অভিযোগ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন বেশি। ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসায়ীদের সমস্যা নিয়ে তাঁকে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সোচ্চার হতে দেখা গেছে বেশি। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে তিনি চেম্বার সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, এটাই তাঁর নেতৃত্বের প্রতি সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।
জীবনে রাজনীতিটাই তিনি বেশি করেছেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি চান্দগাঁও সাবান ঘাটা মৌলভী বংশে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা আতাউল্লাহ, তাঁর ছোট চাচা মওলানা সাদুল্লাহ আলেম, তাঁর দাদা মওলানা আজিজুর রহমান জবরদস্ত আলেম, তাঁকে বংশের একজন সিদ্ধপুরুষ মনে করা হয়। প্রপিতামহ মওলানা আছদ আলী আরো বড় আলেম, মওলানা হিসেবে খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু মওলানা নুরুল ইসলাম রাজনীতিক হিসেবেই অধিক খ্যাতিমান বা কীর্তিমান হয়েছেন। তিনি দুটি স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছেন- দু’বার মানচিত্র বদলে যেতে দেখেছেন। ভারত উপমহাদেশ ভেঙে পাকিস্তান ও ভারত দুটি দেশ সৃষ্টি হয়েছিলো; আবার পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তান বিরোধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক ও সৈনিক ছিলেন তিনি। এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, ইউনুছ খান, ডা. শামসুল আলম চৌধুরী, মওলানা ছালে জহুর, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী-যাঁরা পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের গোড়াপত্তন করছিলেন, মওলানা নুরুল ইসলামও তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। তাদের সমবয়সী এবং বন্ধুস্থানীয় ছিলেন তিনি। বয়সে সিনিয়র ছিলেন শুধু শেখ মোজাফফর এবং আমীর হোসেন দোভাষ। সুতরাং মওলানা নুরুল ইসলাম তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আওয়ামী লীগের পরিমণ্ডলে চলে এসেছিলেন, তা’ নিদ্বির্ধায় বলা যায়। তাছাড়া পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা আন্দোলন এবং চতুর্থ-শ্রেণির কর্মচারী ধর্মঘটে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো। তখন মওলানা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং এসএম হলের আবাসিক। বঙ্গবন্ধুও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি তো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিয়ে গ্রেফতারই হয়েছিলেন। সুতরাং মওলানা ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ভবিষ্যতের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন একথা বললেও অসত্য হয় না। অতএব, একথা সুস্পষ্ট রূপে বলা যায় যে, অধ্যাপক মওলানা নুরুল ইসলাম চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গঠনকাল থেকে এই দলের সঙ্গে ছিলেন এবং যতই সময় এগিয়েছে, ততই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
তবে এটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক যে, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন আলেম দলটির পতাকাতলে সমবেশ হয়েছিলেন। চারজনের নাম তো আমরা পাচ্ছি- মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, মওলানা ছালেহ জহুর ও মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী। এখন আরো একজনের নাম পাচ্ছি-তিনিও মওলানা, মওলানা প্রফেসর নুরুল ইসলাম।
৫০ ও ৬০-এর দশকে গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও সর্বশেষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ চট্টগ্রামে যত আন্দোলন ও সংগ্রামের কর্মসূচি পালন করেছে, তার প্রত্যেকটি সঙ্গে মওলানা নুরুল ইসলাম নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ঝড় উৎপন্ন হয়েছিলো, মওলানা নুরুল ইসলাম তার কেন্দ্রে উপনীত হয়ে অন্যতম নেতা হিসেবে চট্টগ্রামে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ৭০-এর নির্বাচনে তাঁর পাড়ার মানুষ, চেম্বার সভাপতি ইদ্রিস মিয়া জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে মওলানা নুরুল ইসলামের দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছিলো। এলাকার মানুষ হিসেবে তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার চাপ বেড়েছিলো, এমনকি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বও কিছুটা সামাল দিতে হয়েছিলো তাঁকে।
ছাত্রজীবনে প্রখর মেধাবী ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন মওলানা নুরুল ইসলাম। তিনি দারুল উলুম আলিয়া মাদাসা চট্টগ্রাম থেকে লেখাপড়া শুরু করেন। আলিম ও ফাজিল পাস করেন এই মাদ্রাসা থেকে। অতঃপর চট্টগ্রাম সরকারী মুসলিম হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। এরপর কলকাতা গিয়ে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা হতে তিনি স্বর্ণপদক নিয়ে কামিল পাস করেন; তিনি ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেছিলেন। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবিতে অনার্স ও ইসলামের ইতিহাসে এমএ ডিগ্রি নেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর অধ্যাপক মওলানা নুরুল ইসলাম শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর পেশাজীবন আরম্ভ করেন; তাঁর প্রথম কর্মক্ষেত্রে চট্টগ্রাম নাইট কলেজ। তখন সিটি কলেজে নাইট কলেজ রূপেই পরিচিতি ছিলো। নাইট কলেজের তিনিই প্রথম শিক্ষক এবং পরেও সিটি কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি তার সমগ্র কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। তিনি সিটি কলেজে আরবি ও ইসলামের ইতিহাস পড়াতেন এবং পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন।
মওলানা নুরুল ইসলাম শুধু শিক্ষাবিদ নন, তিনি একজন বিশিষ্ট শিক্ষা সংগঠক ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি চন্দনপুরা দারুল উলুম মাদ্রাসা ও চান্দগাঁও এনএমসি হাইস্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন। মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি হাইস্কুলের আজীবন সদস্য, ডায়বেটিক হাসপাতালে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরি পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চিটাগাং চেম্বারের প্রথম সহ সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৭৪ পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৭৯ সালে আবার তিনি নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু ঐ পদে বহাল ছিলেন। পোর্ট ট্রাস্টের ট্রাস্টি ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালে ২০ সেপ্টেম্বর মীর কাশেমের আলবদর বাহিনী তাঁর চান্দগাঁও সাবান ঘাটার বাসা ঘেরাও করে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তারা ছেড়ে দিলেও ২৪ তারিখে আবার পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে চকবাজারের বাসা থেকে আটক করে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়েছিলো। মওলানা নুরুল ইসলাম ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর পরলোকগমন করেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপুলিশের চাকরিচ্যুতের পরও ছাড়েনি অপরাধ জগত