ভাবুন তো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন পৃথিবীতে কোনো কম্পিউটার নেই! কেমন হবে ব্যাপারটা? কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রই কাজ করবে না। আমাদের প্রত্যেকটি ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র চালাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কম্পিউটারের সাহায্য প্রয়োজন। আর কম্পিউটার না থাকলে তো ইন্টারনেট জিনিসটাই এই দুনিয়া থেকে হাওয়া হয়ে যাবে। আপনারা অনেকেই হয়ত জনপ্রিয় নায়ক রজনীকান্তের রোবট ২.০ চলচ্চিত্রটি দেখেছেন। সেখানে পক্ষী রাজা কীভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাতারাতি সব মোবাইল ফোনগুলো গায়েব করে দেয়। মোবাইল ফোন ছাড়া মানুষ কী কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং একটা মোবাইল ফোন পাওয়ার জন্য মানুষ কী রকম ব্যাকুল হয়ে ওঠে তা এই চলচ্চিএের মাঝে অনেক ভালোভাবেই বুঝানো হয়েছে।
সেই রকমই রাতারাতি যদি কম্পিউটারগুলোও গায়েব হয়ে যায়? তাহলে কী হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে বাস্তবে এই রকম রাতারাতি কম্পিউটার গায়েব করা আদৌ সম্ভব নয় কিন্তু ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার দিয়ে পুরো কম্পিউটার সিস্টেমকে অচল করে দেওয়া সম্ভব। ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ কম্পিউটার অচল করে দিয়েছিল ‘চেরনোবিল ভাইরাস’ যাকে সিআইএইচ স্পেসফিলার ভাইরাসও বলা হয়। টাইম বোমার মতো ১৯৯৯ সালের ২৬ এপ্রিল একসাথে বিশ্বের অনেক দেশের কম্পিউটারে একযোগে আক্রমণ করেছিল ভাইরাসটি। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৬০ মিলিয়ন কম্পিউটার আক্রান্ত্র হয়েছিল সেদিন।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। বলা হয়ে থাকে সেই ঘটনারই ১৩তম বার্ষিকীতে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চেরনোবিল ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ভাইরাসটি তৈরির পিছনের কারিগর হচ্ছে তৎকালীন তাইওয়ানের তাতুং ইউনিভার্সিটির ছাত্র চেন ইং-হাউ। সর্বপ্রথম ভাইরাসটি সামনে আসে ১৯৯৮ সালে। তখন এটি তাতুং ইউনিভার্সিটির ডাটা সিস্টেমে ক্ষতিসাধন করে। সেই যাত্রায় চেন ইং-হাউ লঘুদ-ে পার পেয়ে যান কিস্তু পরের বছর ১৯৯৯ সালে এটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এর জন্য চেন ইং-হাউকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
যে ক্ষতি করেছিল সিআইএইচ
- সিআইএইচ ভাইরাস কম্পিউটারে প্রবেশ করলে ম্যালিসাস প্রোগ্রাম চালু করে দিত যা ব্যবহারকারীর অজান্তে কম্পিউটারে চালু থাকত।
- এটি হার্ডড্রাইভের পার্টিশন ও সমস্ত ডাটা মুছে দিত এবং কম্পিউটারের বায়োস সিস্টেমকে অকার্যকর করে দিত।
- ভাইরাসটি উইন্ডোজ ৯৫, ৯৮ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহৃত কম্পিউটারগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল।
- চেরনোবিল ভাইরাসের ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলার।
সেই সময় প্রযুক্তিবিদগণ এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে ২৬শ এপ্রিল আসার আগেই কম্পিউটারের তারিখ পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন কারণ এটি কম্পিউটারে একবার এক্সিকিউট হলে অন্য সব সিস্টেম ফাইল বা ইএক্সই ফাইলকে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং প্রোগ্রামটিকে এমনভাবে সেট করে যে কম্পিউটারের ২৬ এপ্রিল তারিখ হলেই সে দিন যেকোনো প্রোগ্রাম চালু করলেই তা সিআইএইচ-এর ম্যালিসাস কোড চালু করে দেবে এবং কম্পিউটার হ্যাং করবে আর রিস্টার্ট দিলেই সব শেষ।
চেরনোবিল ভাইরাস সম্পর্কে ১৯৯৮ সালেই বিশ্বব্যাপী সবাইকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু অনেক দেশ যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশসমূহ ব্যাপারটিকে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির তথ্য মতে সেই সময় প্রায় দশ হাজারের মতো কম্পিউটার এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল।
একবার ভেবে দেখুন তখন বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার বর্তমানের তুলনায় অনেক কম ছিল। এই ধরনের ঘটনা যদি ২০২২ সালে এসে ঘটে তাহলে তার ভয়াবহতা কী রকম হতে পারে সেটি আপনারাই বিবেচনা করুন।
চেন ইং-হাউকে পরে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল কারণ তিনি ইচ্ছা করে এ কাজ করেননি। অসতর্কতাবশত ম্যালওয়্যারটি ছড়িয়ে পড়েছিল। আর সেই সাথে সাইবার সুরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধ হয় এবং এন্টিভাইরাস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও প্রসার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
কম্পিউটার ভাইরাস থেকে বাঁচতে সর্বদা ভালো মানের একটি এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন সাথে নিয়মিত সফটওয়্যারটি আপডেট রাখুন।
লেখক: কম্পিউটার হ্যাকিং ফরেনসিক ইনভেস্টিগেটর