বন্দর ও টার্মিনালের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে দেশকে স্বাবলম্বীর দিকে নিয়ে যেতে হবে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

বর্তমানে দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল। গত ১৭ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে ডেনমার্কের মায়ের্সক গ্রুপের এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি সইয়ের পর এই আলোচনা গড়িয়েছে রাজপথের বিক্ষোভে। চুক্তি অনুযায়ী, পতেঙ্গায় লালদিয়ার চরে টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে বিদেশি কোম্পানিটি। এ চুক্তির সব শর্ত প্রকাশ করছে না অন্তর্বর্তী সরকার, তাই এটি নিয়ে রয়েছে নানান প্রশ্ন।

তবে মূল কনসেশন চুক্তিটি ৩৩ বছরের। এর মধ্যে নির্মাণে ৩ বছর এবং বাকি ৩০ বছর পরিচালনার। শর্ত পূরণ হলে আরো ১৫ বছর মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ আছে। মোট ৪৯ একর জায়গার উপর এই টার্মিনাল নির্মিত হবে। এতে তিনটি জেটি টার্মিনাল থাকবে যাতে একসাথে ৩টি জাহাজ ভিড়তে পারবে। এতে আট লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানো পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২১ ডলার করে মাশুল পাবে। আর আট লাখের বেশি ৯ লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানো পর্যন্ত প্রতি একক কনটেইনারের জন্য ২৩ ডলার করে পাবে বন্দর। এই দুটি স্তর ছাড়া আরো একটি স্তর রয়েছে। যাতে ৯ লাখের বেশি কনটেইনার ওঠানো-নামানো হলে বন্দরকে আরেকটি স্তরে মাশুল দেবে এপিএম টার্মিনালস। তবে সেই হার কত, তা প্রকাশ করা হয়নি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য কোম্পানিটি ৫৫ কোটি ডলার বা প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর ২৫০ কোটি টাকা ‘আপফ্রন্ট ফি’ (এককালীন ফি) পাবে বন্দর।

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯০% এই বন্দর দিয়ে হয়ে থাকে। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ১ টাকার বিনিময়ে কর্ণফুলী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেন স্থানীয় ও বিদেশী ব্যবসায়ীরা। এরপর ১৮৬০ সালে প্রথম দুইটি অস্থায়ী জেটি ও ১৮৮৮ সালে ২টি মুরিং জেটি নির্মিত হয়। এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে চারটি কনটেইনার টার্মিনাল। এগুলো হলো নিউমুরিং (NCT), চিটাগং (CCT ),পতেঙ্গা (PCT ) আর জিসিবি (GCB ) কনটেইনার টার্মিনাল। এর মধ্যে নিউমুরিং এর ধারণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ১১ লাখ (TEU ) (প্রতিটি ২০ ফুট হিসাবে) আর চিটাগাং এবং পতেঙ্গার হচ্ছে চার/পাঁচ লাখের মত (প্রতিটির)।

তবে পতেঙ্গা ছাড়া বাকি সবগুলো কন্টেইনার টার্মিনাল কর্ণফুলী নদীর বেশ ভেতরে অবস্থিত। সেজন্য এগুলোতে বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। জাহাজের ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে প্রস্তাবিত লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনালের লোকেশনটা একদম সমুদ্রের পাশে, কর্ণফুলী নদীর মোহনার কাছাকাছি। এই লোকেশনের কারণে কন্টেইনার টার্মিনাল হিসেবে লালদিয়া অনেক কনভিনিয়েন্ট হবে। জানা যায়, NCT, CCT ও GCB টার্মিনালগুলো সমুদ্রের কাছাকাছি তৈরি না করে ভেতরের দিকে নদীর তীরে তৈরি করা হয়েছিল-মূলত ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মানে বঙ্গোপসাগরের উপকূলের বৈরি আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। প্রশ্ন হলো সাগরের একেবারে মুখে কি বন্দর সাসটেইনেবল হবে? এ বিষয়ে কর্মকর্তাদের অভিমত, ডেনমার্ক-যাদের উত্তাল সমুদ্র সামলানোর ইতিহাস অনেক পুরনো ও গভীর – সেরকম দেশের কোম্পানিকে এই টার্মিনাল তৈরীর কাজ দেওয়া হয়েছে। কারণ তারা এমন টার্মিনাল তৈরি করার সক্ষমতা রাখে। যেটা সমুদ্রের বৈরি আবহাওয়া ও অনিশ্চয়তাকে সামাল দিয়ে একটা কন্টেইনার টার্মিনালকে চালু রাখতে পারে। তবে আশঙ্কার কথা হলো বাংলাদেশে যে পরিমান পণ্য আমদানি করে, তার সিংহভাগ পরিবহন করে মার্কস লাইন কোম্পানি। তারা এই টার্মিনালটি নির্মাণ শেষে তাদের আনীত জাহাজগুলো এই টার্মিনালে ভিড়াবে, বন্দরে ভিড়ানো জাহাজের সংখ্যা কমে যাবে। এতে বন্দরের কাজ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে এবং আয়ও কমে যাবে।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর সমপ্রতি ৪১% ট্যারিফ বৃদ্ধি করেছে। এতে ১৬৮টি সেবার উপর ২০-৩০% পর্যন্ত শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, যা বন্দর পরিচালনায় আন্তর্জাতিক কোম্পানিকে আর্কষণ এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। যদিও এই বর্ধিত ট্যারিফের ফলে আমদানি রপ্তানির খরচ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তার উপর প্রভাব ফেলবে।

এদিকে আইএফসি এক সমীক্ষায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া এই সাত দেশের ১৪টি বন্দর ও টার্মিনালের মাশুলের তুলনা করেছে। বন্দরের মাশুল বাড়ানোর আগে গত মার্চের এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে আঞ্চলিক ১০টি বন্দর বা টার্মিনালের মাশুল কম। তিনটি বন্দরের মাশুল চট্টগ্রামের চেয়ে বেশি। যেমন প্রতিটি বক্স কনটেইনার (২০ বা ৪০ ফুট লম্বা কনটেইনার) চট্টগ্রাম বন্দরে ওঠানো-নামানো ও রাখার মাশুল গড়ে ছিল ১২৬.৬৬ ডলার। এই মাশুল শুধু শ্রীলঙ্কার সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনাল (এসএজিটি), মিয়ানমার ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালস থিলাওয়া (এমআইটিটি) এবং ভারতের এপিএম টার্মিনালস পিপাভবের মাশুলের চেয়ে কম ছিল। তবে পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের প্রতিযোগী কম্বোডিয়ার নমপেন বন্দর, থাইল্যান্ডের ল্যাম চাবাং ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল, মালয়েশিয়ার তেনজুন পেলাপাস, ভিয়েতনামের হোচিমিন সিটির ভিয়েতনাম ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার টার্মিনালসহ ১০টি টার্মিনালের চেয়ে বেশি ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল। অন্যদিকে বছরের বেশির ভাগ সময় বন্দরে জাহাজ জটের কারণে খরচ বেশি হতো। কিন্তু মাশুল কম থাকায় শিপিং এজেন্টগুলো তা পুষিয়ে নিতে পারত। এখন মাশুল বাড়ানোয় বন্দর আরো ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে। আইএফসির সমীক্ষা আমলে নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিমত হলো, নতুন মাশুল কার্যকর হলে তাতে বন্দরে প্রতিটি বক্স কনটেইনারে ব্যয় দাঁড়াবে কমবেশি ১৮৬ ডলার। তার মানে হলো, মাশুল কার্যকরের পর ১৩টি বন্দরের মাশুলের চেয়ে চট্টগ্রামের মাশুল বেশি হবে। শুধু শ্রীলঙ্কার সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনালের চেয়ে কম। তবে এই বাড়তি রেইটের সুফল ভোগ করবে বিদেশি অপারেটরেরা। কারণ গত বছর চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনালের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চালু থাকা নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল কিছুদিনের মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া হবে। নির্মিতব্য লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ডেনমার্কের এপিএম টার্মিনালসকে দেওয়া হয়েছে। বে টার্মিনাল প্রকল্পের দুটি টার্মিনাল সিঙ্গাপুরভিত্তিক পিএসএ ইন্টান্যাশনাল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কাজ চলছে। ফলে বাড়তি মাশুলের কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। রপ্তানি খাতেও এটা পণ্যের দামের সঙ্গে হিসাব হবে। বিদেশি ক্রেতারা বাড়তি দাম দিতে চাইবে না। ফলে রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হবে।

লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হলে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের অনিয়ম ও দুর্নীতি কিছুটা হলেও লাঘব হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশনের সাথে যুক্ত কোন স্টাফই বাড়তি উপরি ছাড়া কোন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন না।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় ছিল ৫,২২৭ কোটি টাকা এবং নিট মুনাফা ২,১৮৪ কোটি টাকা। রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ৮.২২%। রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদান করেছে ১,৭৬৫.২৬ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭টি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা এক অর্থবছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে একটি নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।

আসলে দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছাতে হলে বন্দরের বহুমুখী ব্যবহার ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। তবে এটিও খেয়াল রাখতে হবে, যেসব বন্দর বা টার্মিনাল আমরা নির্মাণ করছি সেগুলোর পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবো কিনা। অন্যদিকে মাতারবাড়ি ডিপ সিপোর্টকে আঞ্চলিক বন্দর হিসাবে গড়ে তুলতে হলে ভারতের সেভেন সিস্টারসহ নেপাল ভুটানের মালামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। না হয় বিপুল ব্যয়ে নির্মিত ডিপ সিপোর্ট লাভজনক হবে না। তাই সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে সুচিন্তিত ও সুদূরপ্রসারি কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশকে স্বাবলম্বীর দিকে নিয়ে যেতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন এক বাংলাদেশের অপেক্ষায় আছি
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষায় MoU বা মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং