কক্সবাজারে সুপারি চাষ বাড়ছে, ফলন-দামে চাষিরা খুশি

২ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে চাষ, উৎপাদন ১৬ হাজার মেট্রিক টন

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | বৃহস্পতিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল সুপারি চাষে প্রসিদ্ধ কক্সবাজার জেলা। জেলার উখিয়া ও টেকনাফে দেশের সর্বোচ্চ সুপারি উৎপাদন হয়। আর এ বছর চাষ হয়েছে ২২৫০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া জেলার অন্যান্য উপজেলাগুলোতেও সুপারি চাষ হয়। আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন ও অনুকূল আবহাওয়া থাকায় দিন দিন এ অঞ্চলে বাড়ছে সুপারি উৎপাদন। এতে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। আর দেশে চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে বর্তমানে। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, কক্সবাজারে সামপ্রতিক বছরগুলোতে সুপারি উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে প্রতি বছর ২ হাজার কোটি টাকার মতো সুপারি উৎপাদন হয়। চলতি বছর এই পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। এখানকার উৎপাদিত সুপারির গুণগতমান ভালো হওয়ায় তা জেলাবাসীর চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখের মতো সুপারি গাছ রয়েছে। যেখান থেকে প্রায় ১৬ হাজার মেট্রিক টন সুপারি উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বেশি সুপারি উৎপাদনের এলাকা উখিয়াটেকনাফ। এখানকার সুপারিতে কোনো ধরনের কষ নেই। খেতে নারিকেলের মতো। এজন্য টেকনাফ ও উখিয়া উপকূলীয় এলাকার সুপারির চাহিদা আছে সারাদেশে।

কৃষি সমপ্রাসরণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় প্রায় ২ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে সুপারির চাষ হয়। তার মধ্যে চকরিয়া ৮০ হেক্টর, পেকুয়া ৭, রামু ৩২০, কক্সবাজার সদর ১০০, উখিয়া ৯৭০, টেকনাফ ১২৮০ ও মহেশখালীতে ৫ হেক্টর জমিতে সুপারির চাষ হয়। তবে কুতুবদিয়া উপজেলায় সুপারির চাষ হয় না।

চলতি মৌসুমে বিগত কয়েক মৌসুমের চেয়ে অধিক সুপারি উৎপাদন হয়েছে। বর্তমানে ভরা মৌসুম চলছে। তাই উৎপাদিত সুপারি চাষিরা বাজারে তুলে বিক্রি করছে। এতে জমজমাট বেচাকেনা হচ্ছে। বিশেষ করে উখিয়া ও টেকনাফের সুপারি আড়তে এখন বেচাকেনায় রমরমা পরিবেশ বিরাজ করছে।

উখিয়া উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সুপারি উৎপাদন হয় উপকূলীয় ইউনিয়ন সোনারপাড়ায়। সেখানকার কৃষক হামিদুল হক জানান, সুপারি গাছেও বিভিন্ন সময় নানা কারণে মড়ক সৃষ্টি হয়। বিগত কয়েক বছর সমুদ্র থেকে বয়ে আসা লবণাক্ত বাতাস, অনিয়মিত বৃষ্টি, আর অতিরিক্ত গরমে তার সুপারি বাগান এক সময় প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। গাছের আগা পুড়ে যেত, পাতা ঝরে পড়ত, ফলন নামত অর্ধেকে। তিনি জানান, কিন্তু এবারের মৌসুমে দৃশ্যটা সম্পূর্ণ উল্টো। তার প্রায় ১ একর জমিতে সারি সারি গাছে ঝুলছে সোনালি ফলন পাকা সুপারি। হামিদুল হকের মুখে এখন সন্তুষ্টির হাসি।

টেকনাফের চাষি হাসান শরীফ বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে এখন মাটির পানি নিষ্কাশন, ছায়া তৈরি, জৈব সার আর আগাছা নিয়ন্ত্রণ করছি। গাছ এখন শক্ত, ফলন দ্বিগুণ হয়েছে। ২০ শতকের একটি বাগান থেকে এবার প্রায় দেড় লাখ টাকার সুপারি বিক্রি করেছি।

জাহাজপুরা এলাকার ইরফান আজাদ জানান, প্রতি মৌসুমে কাঁচা, শুকনো এবং ভেজা সুপারি সংগ্রহ করে প্রায় ১৬০ শতক জমি থেকে আমাদের পরিবারের আয় হয় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা। আগে বন্যা ও জোয়ারের পানি প্রবেশ বা সমুদ্র থেকে বয়ে আসা লবণাক্ততার কারণে ফলন কমে যেত। এছাড়া বাতাসের শক্তি অনেক সময় সুপারি গাছের আগা ভেঙে দিত। কিন্তু এখন উপকূলে ঝাউবিথী রোপণের কারণে বাতাস আর লবণাক্ততার ধাক্কা ঝাউ গাছের মাধ্যমে সুপারি বাগানে পৌঁছায় না। ফলশ্রুতিতে আমাদের সুপারি গাছগুলো সবল ও স্বাস্থ্যবান আছে এবং দারুণ ফলন দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে সুপারি সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয়েছে। আমার বড় চাচা এরশাদুর রহমান ৪.৮ একর জমিতে সুপারি গাছ লাগিয়ে প্রতি মৌসুমে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা আয় করেন।’ এভাবে উখিয়া সোনারপাড়ার আব্দুল মোনাফ, পাটোয়ারটেক এলাকার সৈয়দ হোসেন ও টেকনাফের জাহাজপুরা এলাকার ইরফান আজাদসহ বহু চাষি এখন আবহাওয়া বুঝে পরিকল্পিত চাষ করছেন।

সরেজমিনে উখিয়াটেকনাফের উপকূলীয় এলাকায় বেশ কয়েকটি সুপারি বাগান ঘুরে দেখা যায়, গাছের সারি এখন যেন সবুজের সমারোহ। সারি সারি গাছে ঝুলছে কমলার মতো বড় আকারের সুপারি। বাতাসে ভেসে আসছে কাঁচা সুপারির স্নিগ্ধ গন্ধ, আর কৃষকদের মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি।

উখিয়ার সোনার পাড়া সুপারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সপ্তাহে দুই দিন এই বাজার বসে। এই বাজারে উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে সুপারি বিক্রি করতে আসে চাষিরা। তেমনি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রয় করতে আসে বড় বড় পাইকাররা। এতে পুরো বাজার গমগম করে। বেচাকেনা চলে জোরেসোরে। দামও বেশ বাড়তি পেয়ে খুশি চাষিরা।

টেকনাফের শামলাপুর বাজারের ক্রেতা শাহজালাল বলেন, এখন বাজারে ৮০টি সুপারি ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা বাগান থেকে একটু কম দামে সংগ্রহ করে শুকানো ও পরিবহন খরচ হিসাব করেও ভালো লাভ রাখতে পারি। আরেক পাইকারি ব্যবসায়ী আবু সিদ্দিক বলেন, কৃষকদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম দামে কাঁচা বা শুকনো সুপারি কিনে আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও রাজশাহীর বাজারে সরবরাহ করি। সেখানকার পাইকারি ক্রেতাদের কাছে এই সুপারির চাহিদা অনেক বেশি, কারণ উপকূলের মাটিতে উৎপাদিত সুপারি শক্ত ও টেকসই হয়। প্রতি মৌসুমে এভাবেই ভালো মুনাফা করা যায়।

এ ব্যাপারে কক্সবাজার কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, সুপারি চাষ অতীতের চেয়ে অনেক সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সুপারির দাম কোনোভাবেই পতন হয় না। চলতি মৌসুমে চাষও ভালো হয়েছে। ফলে দেশে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সুপারির ভালো ফলন পেতে কৃষি বিভাগ সব সময় চাষিদের পাশে রয়েছে। মড়ক নিধন, উন্নত প্রযুক্তির উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োগ এবং সার সরবরাহ ও যথাযথ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটিয়ায় বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে কার চালক নিহত
পরবর্তী নিবন্ধনাফ নদী থেকে ৬ রোহিঙ্গা জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি