আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার : কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

এস এম ওমর ফারুক | মঙ্গলবার , ৪ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

অবৈধ অস্ত্র উন্নয়নশীল দেশের নির্বাচনী পরিবেশে একটি সংকটজনক বিপদ। অস্ত্রের সহজ প্রাপ্যতা ভোটারদের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে, নির্বাচনী সহিংসতা বাড়ায়, বিরোধী মতের দমনচর্চাকে উৎসাহিত করে এবং স্বতন্ত্র/নিরপেক্ষ ভোটের সম্ভাব্যতা সংকুচিত করে। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর অর্গানাইজড কাওয়ার্ড বা অনিয়ন্ত্রিত অনুসারীরা অস্ত্র ব্যবহার করে ভীতি ছড়াতে পারে; অন্যদিকে সশস্ত্র অপরাধী বা চোরাচালানী জালিয়াতির জন্য অস্ত্র ব্যবহৃত হলে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, Small Arms Survey প্রোগ্রাম ও UNODCসংক্রান্ত বিশ্লেষণে অবৈধ অস্ত্রের বহুল মাত্রার নেতিবাচক প্রভাব বিশদভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী সরকারি রিপোর্ট ও সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে বহু অস্ত্র সরকারি স্টোর থেকে চুরি/লুট হয়ে নিখোঁজ আছে এবং বাজারে বিচরণ করছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে গত বছরের জুলাইয়ে পুলিশ স্টেশনগুলো থেকে ১,৩০০ টির বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রায় ২,৫০,০০০ রাউন্ড গুলি তথাকথিত লুটের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে; এদের অনেকটি এখন অপরাধীদের হাতেই রয়েছে। এই হার নির্বাচনী সময় নিরাপত্তাহীনতা বাড়ায়।

সীমান্ত নিবিড় অপারেশন ও অভিযানের ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় ইএই ও সেনাপুলিশ একাধিক শৃঙ্খলাভঙ্গকারী ইউনিটে অভিযান চালিয়ে বন্দুক, পিস্তল, রাইফেল, গ্রেনেড ইত্যাদি উদ্ধার করেছে যেমন সাম্প্রতিক তিন মাসের প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি পিস্তল, সাবমেশিনগান ও বেশ কিছু রাউন্ড গুলি উদ্ধার কার্যক্রম রেকর্ড করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্র উৎপাদননেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে অভিযানে একাধিক ক্ষেত্রে অবৈধ অস্ত্র কারখানা বা ওয়ার্কশপ উন্মোচিত হয়েছে; সামরিক ও গোয়েন্দা সূত্রে সীতাকুণ্ড অঞ্চলে একটি স্থানীয় অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র ধ্বংস ও গ্রেপ্তার ঘটনার রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং নির্বাচনের আগে বিশেষ ‘কোম্বিং’ও নিয়ন্ত্রিত সাঁড়াশি অভিযানের কথা বলা হচ্ছে ।

উপরে বর্ণিত সত্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের সমস্যা একদিকে সীমান্তচ্যানেল ও ঘরোয়া উৎপাদন থেকে আসে, অন্যদিকে অতীতের বড় লুটঘটনা (police armoury looting) বাজারে অস্ত্র যোগান বাড়িয়েছে; এগুলো নির্বাচনী সহিংসতায় ব্যবহার হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করেছে।

বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় অস্ত্র উদ্ধারের বাস্তব পদক্ষেপ নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে সাহায্য করে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দেশের কার্যক্রম উল্লেখ করা যায়, কোসোভো (Kosovo) ২০০১ সালের ‘Essential Harvest’ অপারেশন ও পরবর্তীতে আমনেস্টি/অস্ত্র সংগৃহীত উদ্যোগে কয়েক হাজার ছোট অস্ত্র সাফল্যভাবে নিক্ষেপ/নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল; অস্ত্রসংগ্রহ উন্নত হলেও সামাজিক পুনর্মিলনের সাথে সমন্বিত না থাকলে পুনরায় অস্ত্র সঞ্চয় বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ শুধু অস্ত্র সংগ্রহ করে দিলে শেষ কথা নয় সামাজিক পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা প্রদান দরকার।

কলম্বিয়া (Colombia), FARCসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর ডিমোবিলাইজেশনের অংশ হিসেবে হাজার হাজার অস্ত্র হস্তান্তর করা হয়; নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তা স্বল্পকালীনভাবে সহিংসতা হ্রাস করেছে, কিন্তু অস্ত্র নিষ্কাশন/নিঃশেষকরণে দুর্বলতা, আঞ্চলিক ‘অন্য’ সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ও ইমপিউনিটির কারণে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

কেনিয়া ২০০৭৮ পরবর্তী নির্বাচনী হিংসার গবেষণাগুলো দেখায় যে অবৈধ অস্ত্রের সাধারণ প্রবাহ ও অস্ত্রবহুল পরিবেশ ভোটপথে গণহারে সহিংসতা সৃষ্টি করেছে; অস্ত্র সীমিত না করলে পুনরায় নির্বাচনের সময় সহিংসতা ঝুঁকি থাকে।

এই কেসগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে বলা যায়, অস্ত্র উদ্ধার কার্যক্রম যদি কেবল ফৌজদারি অভিযানেই সীমাবদ্ধ থাকে আর সামাজিক পুনর্বাসন, স্থিতিশীল কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক সহনশীলতা ও স্থানীয় নেতাদের অংশগ্রহণ না থাকে তবে তা পূর্ণ সাফল্য নিশ্চিত করতে পারে না।

নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে কয়েকদফায় (phased) অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের একটি রূপরেখা সংশ্লিষ্ট সবার বিবেচনার জন্য নিচে (জাতীয়ভাবে প্রয়োগযোগ্য একটি বাস্তবসম্মত, ধাপভিত্তিক ) দেওয়া হলো:

ফেজ ১ প্রস্তুতি ও ডেটাঅ্যাসেসমেন্ট :

অস্ত্রউদ্ধার, সীমান্তরেকর্ড, লুট হওয়া স্টোরইনভেন্টরি, পূর্ববর্তী অপরাধ রিপোর্ট ইত্যাদি মিলিয়ে জাতীয় অস্ত্রডাটাবেস আপডেট। (মেটাডেটা ও ‘হটস্পট’ চিহ্নিত)

স্থানীয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, ও নিরাপত্তা সংস্থার সমন্বিত রণনীতি তৈরী।

ফেজ ২গোয়েন্দা ও সীমান্তনিয়ন্ত্রণ শক্তিশালীকরণ :

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় অভিযানে লক্ষ্যভিত্তিক রেইড বড় এক্সেসরিসহ হাটবাজার ও অস্ত্রচোরাচালান চ্যানেল, সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো; গ্রামাঞ্চলে মাইক্রোইনফরম্যান্ট নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। (বর্তমান ইএইর সফল সীমান্ত অভিযানগুলোর মতো উদ্যোগ চলমান হওয়া জরুরি)

ফেজ ৩ কমিউনিটি আউটরিচ ও অনুপ্রেরণা :

সময়সীমা ভিত্তিক অস্ত্রহস্তান্তর মামলা রেহাই/অল্প ক্ষতিপূরণসহ ‘হ্যান্ডইন’ করানো কিছু দেশে এটি কার্যকর হয়েছে; তবে একই সঙ্গে ব্যবহারকারীদের বিকল্প কর্মসৃজন ও সুরক্ষা নিশ্চয়তায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করতে হবে।

ফেজ ৪ টার্গেটেড অপারেশন ও সংগ্রহের দ্রুততা :

নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে নিবিড় ‘কোম্বিং অপারেশন’ আইনি প্রক্রিয়ার অধীনে, মানবাধিকার গাইডলাইন মেনে।

পাওয়া অস্ত্রের সুরক্ষিত ডিপোতে রেকর্ড ও দ্রুত বিশ্লেষণ; অপরাধমূলক ব্যবহারের সূত্রস্থলে আর্থিকআইনি পদক্ষেপ। ফেজ ৫ ধ্বংস, কোর্টপ্রক্রিয়া ও পুনর্বাসন :

অপ্রয়োজনীয়/অস্বীকৃত অস্ত্র নিরাপদ পদ্ধতিতে ধ্বংস করা; এর রিপোর্ট ইন্টারন্যাশনালি টেকনিশিয়াল টিমের সহায়তায় করা উচিত।

গ্রেপ্তারকৃতদের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ অভিযোগপ্রক্রিয়া ও দ্রুত বিচার, রিসোশালাইজেশন প্রোগ্রাম চালু রাখা।

ফেজ ৬ পোস্টইভ্যালুয়েশন ও টেকসই পদক্ষেপ :

নির্বাচনের পর প্রভাব মাপার জন্য স্বাধীন মনিটরিং; পুনরায় অস্ত্র বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে কিনা সেটি মূল্যায়ন করে নীতি সংশোধন।

উপরে বর্ণিত ধাপগুলো সঠিকভাবে ও সমান্তরালভাবে প্রয়োগ করলে নির্বাচনী সহিংসতা ও ভয়ের পরিবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে পারে। অপরদিকে না করলে অস্ত্রের উপস্থিতি ভেতরেভেতরে নির্বাচনী ফলাফলকে বিকৃত করতে পারে ভোটার টার্গেটিং, বিরোধী শক্তির দমন, নির্বাচনী জবরদস্তি ইত্যাদি ঘটনার ঝুঁকি থাকে। বৈশ্বিক কেস স্টাডি নির্দেশ করে যে, অস্ত্রউদ্ধার সফল হলে স্বল্পকালীন শান্তি আসে, কিন্তু তা টেকসই করতে হলে সামাজিক পুনর্গঠন, ন্যায়বিচার ও ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার একসঙ্গে প্রয়োজন।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশে (এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে) অবৈধ অস্ত্র নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু কার্যকারিতার জন্য প্রধান হুমকি। সাম্প্রতিক সংবাদও সরকারি সূত্রগুলো দেখায় অস্ত্র উদ্ধার ও সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি আছে, কিন্তু ২০১০/২০২০ দশকের বড় লুট বা বৈরী ঘটনা এখনও ঝুঁকি রেখে দিয়েছে। দ্রুত, গোয়েন্দানির্ভর, পারস্পরিক সম্মিলিত এবং সামাজিক পুনর্বাসনসহ একটি বহুমুখী ধাপ সম্বলিত কার্যক্রম গ্রহণ না করলে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন ব্যাহত হবার জোরালো আশংকা থেকে যায়। আন্তর্জাতিক সুপারিশ ও অভিজ্ঞতা (Kosovo, Colombia, Kenya) থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা ব্যবহার করে বাংলাদেশে নির্বাচনের পূর্বে কার্যকর অস্ত্র উদ্ধার ও সমাজিক পুনর্গঠনের কাজ জরুরি ও সময়োপযোগী।

লেখক : প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধচতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলা করতে হলে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধএনসিপির পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা যুবদলের নেতার