মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৭ জুন, ২০২৫ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

সারা বিশ্ব এখন চরম অস্থিরতায় ভুগছে। ইরানইসরায়েল যুদ্ধের কারণে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের দিনকাল গভীর শংকার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত ১৩ জুন পৃথিবীর কুখ্যাত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্র, বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, আবাসিক ভবনসহ অসংখ্য স্থাপনায় ২০০টি যুদ্ধ বিমান দিয়ে হামলা করেছে। এতে আইআরজিসি’র প্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরী, মেজর জেনারেল সোলাইমানি সহ শীর্ষ ৯ পরমাণু বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য সামরিক কমান্ডারসহ মোট ২৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এরপর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠে। এতে বেসামরিক নাগরিকসহ ৭০ জনের মৃত্যু ঘটে। ১৩ জুন থেকে আজ এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ শতাধিক ইরানি সাধারণ নাগরিক, সামরিক কর্মকর্তা, আইআরজিসি’র কর্মকর্তা সহ অসংখ্য সাধারণ নিরপরাধ নারী পুরুষ নিহত হয়েছে ইসরায়েলের বর্বর হামলায়। প্রথম দিনেই ইরানের ৮টি শহরে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে বর্বর ইসরায়েল। হামলার লক্ষ্যবস্তুু করা হয়েছে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ইসরায়েল এই অভিযানের নাম দিয়েছে অপারেশন ‘রাইজিং লায়ন’। নামটি নেওয়া হয়েছে খ্রীস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল থেকে। ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতাকে বড় হুমকি হিসেবে দেখার কারণেই ইসরায়েল এই হামলা চালিয়েছে বলে মধ্যপ্রাচ্যের কসাই খ্যাত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানিয়েছেন। ইরানইসরায়েলের এই সংঘাতে উভয় পক্ষের অনেক সামরিক স্থাপনা, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন, অফিসআদালত, গাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলের আগ্রাসনের জবাবে ইরান শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা ইসরায়েলের দিকে একের পর এক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ইসরায়েলের অনেক স্থাপনা ধ্বংস করেছে। যদিও ইসরায়েল নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে, তবে স্থাপনাটি থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়নি বলে আইএই একে জানিয়েছে ইরানি কর্তৃপক্ষ। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বিশ্বস্ত আইআরজিসি’র প্রধান হোসেন সালামি, ইরানের সেনা প্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি, ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কোরের বিমান বাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ ও এতে নিহত হয়েছেন। ইরান ও ইসরায়েলের শত্রুতা বহু পুরানো। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় দেশটির পশ্চিমপন্থী নেতা মোঃ রেজা শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি ইসরায়েলকে তেহরানের বন্ধু হিসেবে মনে করতেন। এরপর ক্ষমতায় আসা শাসকরা ইসরায়েলকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে আসছেন। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ইরানইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে জোরেসোরে তদবির চলছে আর এর মধ্যস্থতা করছেন ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অথচ ইরানে মার্কিন হামলার বিষয়ে অনুমোদন দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই। সেই ট্রাম্পই আবার যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে এসেছেনএটা আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হয়। ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছেন কিন্তু এর ৩ দিনের মাথায় ইরানের ৩টি পারমাণবিক স্থাপনা ফরদো, নাতাঞ্জ, ইসফাহানে হামলা চালিয়েছে বিশ্বের দুর্ধর্ষ বোমারু বিমান বি২ দিয়ে। যেটি ১৩ হাজার টন ওজনের বাংকার ব্লাষ্টার বোমা বহন করতে সক্ষম। এতে ইরানের উক্ত ৩টি পারমাণবিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইরানি কর্তৃপক্ষ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ভেরিফাইড পেইজ ট্রুথ সোশ্যালে মার্কিন বিমান হামলার কথা স্বীকার করেছেন এবং হামলার পর নিরাপদে বিমানগুলো আমেরিকায় পৌঁছে গেছে বলেও জানিয়েছেন। এর ৪৮ ঘন্টা পেরোতে না পেরোতেই মধ্যপ্রাচ্যের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত কাতারের আল উদেইদ বিমান ঘাঁটিসহ ইরাক ও সিরিয়ার মার্কিন ঘাঁটিতে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইরান। এতে ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। বরাবরই ট্রাম্প মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছিল। এখনও যুদ্ধ বিরতির আড়ালে সে এক মহানাশকতার পরিকল্পনা আঁটছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। কারণ ট্রাম্প একজন মিথ্যাবাদী শাসক হিসেবে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিত। খোদ মার্কিনিরা তার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমেরিকার কয়েকটি শহরে ইরানের সাথে যুদ্ধ জড়ানোর কারণে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ইরানে হামলার এই পরিকল্পনাকে অর্থহীন মনে করছেন মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের চলমান পরিস্থিতি জটিল হওয়ার শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা। এই হামলার মধ্য দিয়ে আমেরিকা ইরানকে একটি বার্তা দিচ্ছে, ‘হয় শান্তি স্থাপন কর, নইলে আরও বড় ধরনের হামলা আসবে’ ইরানের উপর। কিন্তু দুঃসাহসী ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ট্রাম্পের এই হুঁশিয়ারীকে থোড়াই কেয়ার করছেন। ইসরায়েলে হামলার পাল্টা জবাবে ইরান প্রতিদিন অসংখ্য মিসাইল, ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের হাইফা, তেলআবিব সহ একাধিক শহরের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, গুরুত্বপূর্ণ অফিস, আবাসিক ভবন লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালাচ্ছে যা ইসরায়েল কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। যে ইসরায়েলিরা গাজার নিরপরাধ মানুষদের পরিণতি দেখে অট্টহাসিতে মেতে উঠতো আজ সেই গাজার পরিণতি স্বচক্ষে দেখছে অকৃতজ্ঞ ইসরায়েলিরা। আজ ইরানের হামলার ভয়ে হাজার হাজার ইসরায়েলি মাটির নিচে বাংকারে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক ইসরায়েলি দেশ ত্যাগ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যাওয়ার ঘটনা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত ইহুদিদের কান্নায় ইসরায়েলের আকাশ যেন ভারী হয়ে উঠছে। আঠারো মাস ধরে গাজায় আগ্রাসন চালানো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা দেখে যেন অবাক। নিজেও কল্পনা করতে পারেনি যে ইসরায়েলের অসংখ্য শহর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস হয়ে যাবে। যেই ইস্যু নিয়ে ইরানইসরায়েলের সংঘাত শুরু হয়েছে, সেটি হল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর বিষয়। অথচ আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থা ঘোষণা করেছে যে, ইরানে পারমাণবিক অস্ত্রের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। অথচ একটি মিথ্যা অজুহাতে দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে দেশটির অধিকাংশ অঞ্চলকে বিরাণ ভূমিতে পরিণত করেছে। পৃথিবীতে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। অথচ ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর পথে আছে তার কোন অকাট্য দলিল নেই। কিন্তু পারমাণবিক কর্মসূচী শুধুমাত্র গবেষণার স্বার্থে করছে বলে বারবার ইরানের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। গাজায় ৫৫ হাজারের উপরে নিরপরাধ নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে মধ্যপ্রাচ্যের কসাইখ্যাত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। গাজাকে মাটির সাথে গুঁড়িয়ে দিয়েছে অবাধ্য নেতা বেনিয়ামিন। পাশাপাশি ইয়েমেন, লেবানন, সিরিয়াতে চরম আগ্রাসন চালিয়েছে বর্বর ইসরায়েল। পৃথিবীর বিষফোঁড়া হিসেবে খ্যাত ইসরায়েলের বাড়াবাড়িতে চরম অতিষ্ঠ বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আর এই দেশটি প্রথমেই হামলা চালাল ইরানে। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরানের। তারা হারিয়েছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোকে, যেমন: পরমাণু বিজ্ঞানী, মেধাবী সামরিক কমান্ডার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী সহ অসংখ্য উদীয়মান মেধাবীকে। ইরান কি এই ক্ষত আদৌ শুকোতে পারবে? ইরানের তুলনায় ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি নিতান্তই কম। তারা কোন সামরিক কর্মকর্তা হারায়নি। বেসামরিক মানুষও হতাহত হয়নি খুব বেশি। এরপরও ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাব সারা বিশ্বকে হতবাক করেছে। এই ইহুদী জাতি একটি অবাধ্য ও অভিশপ্ত জাতি, যা আল্লাহর কোরানের অনেকগুলো আয়াতে বলা হয়েছে। বনী ইসরায়েল খ্যাত ইহুদি জাতি আল্লাহর নবী মুসা (আঃ) কে অপদস্থ করেছে, অপমান করেছে। এই জাতিকে আল্লাহতায়ালা উন্নতির শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদেরকে অসংখ্য নেয়ামত দেওয়া হয়েছিল। তারা কিন্তু সেই নেয়ামতের গুরুত্ব না বুঝে বারবার আল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা হযরত জাকারিয়া (আঃ), হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) সহ অসংখ্য নবীকে হত্যা করেছে। সেই ইহুদীর বংশধররা আজ সারা বিশ্বব্যাপী দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাত্র দেড় কোটি ইহুদি সারা বিশ্বের মানুষকে নাকে খত দিয়ে ঘুরাচ্ছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি তাদের হাতে। সারা বিশ্বব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে অবাধ্য ইহুদী জাতিরা। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতির নামে এক মহাপ্রহসন চলছে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে এটি ট্রাম্পের একটি ট্রাম কার্ড। বিশ্বকে বোকা বানিয়ে ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষায় তার দুরভিসন্ধিমূলক প্রহসন। তারা কোনদিন শান্তি চায়নি। শান্ত পৃথিবীকে অশান্ত করাই আমেরিকা, ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের মূল উদ্দেশ্য। আর মোনাফেক মুসলিম বিশ্ব মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে এবং ইহুদিদের পা চাটা কুকুর হিসেবে খ্যাত সৌদি যুবরাজ সালমান, কাতার, আমিরাত, জর্ডান, বাহরাইনের শাসকরা চেয়ে চেয়ে ইরানের মুসলমানদের পরিণতি দেখছে। মুসলমান নামধারী রাষ্ট্রগুলোর মোনাফেকি চরিত্র এখন সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধএত কষ্ট কার কাছে রাখব
পরবর্তী নিবন্ধখোশ আমদেদ ১৪৪৭ : হিজরি নববর্ষের তাৎপর্যপূর্ণ পটভূমি