গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল হামলা শুরু করে ইরানে। এরপর শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে হামলা পাল্টা হামলা। সেই সংঘাতের দশম দিনে এসে এই যুদ্ধে জড়াল আমেরিকা। তারা সরাসরি হামলা চালিয়েছে ইরানের তিন পরমাণুকেন্দ্র লক্ষ্য করে। স্থাপনাগুলো হলো ফোরদো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান। যুক্তরাষ্ট্রের বি–২ স্টেলথ বোমারু বিমান ইরানে এ হামলায় অংশ নেয়। এদিকে, ইরানের কর্মকর্তারা বলেছেন, হামলা চালানো স্থাপনাগুলো থেকে আগেই পারমাণবিক সরঞ্জামাদি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
ফোরদোর ওপর ছয়টি ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ফেলা হয়েছে। এ বোমা সরাসরি ভূপৃষ্ঠের ৬০ মিটার গভীরে ঢুকে গিয়ে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম। এই বোমা ১৮ মিটার গভীর শক্তিশালী কংক্রিটের গাঁথুনিও ভেদ করার ক্ষমতাসম্পন্ন। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, কোনো সামরিক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম তাদের অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা এ বোমা ব্যবহার করেছে। হামলা চালাতে মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের বি–টু বোমারু বিমানগুলোকে একটানা ৩৭ ঘণ্টা উড়িয়ে নিয়ে গেছে, যাওয়ার সময় আকাশপথেই সঙ্গী ট্যাংকার বিমান থেকে জ্বালানি নিয়েছে স্টেলথ বোমারু বিমানগুলো। নাতাঞ্জ ও ইস্পাহান পারমাণবিক কেন্দ্রেও হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দুটি কেন্দ্রে হামলা চালাতে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে মার্কিন বাহিনী। লক্ষ্যে নির্ভুল আঘাত হানার ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়েছে মার্কিন ডুবোজাহাজ থেকে। তবে নাতাঞ্জে দুটি জিবিইউ–৫৭ বাঙ্কার ব্লাস্টার বোমাও ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইরানের তিনটি প্রধান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘বছরের পর বছর সবাই এই নামগুলো শুনেছে, তারা এই ভয়ানক ধ্বংসাত্মক প্রকল্প গড়ে তুলছিল। আজ রাতে আমি বিশ্বের কাছে জানাতে পারি, এই হামলাগুলো ছিল একটি অসাধারণ সামরিক সাফল্য।’ তিনি দাবি করেন, ‘ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথও বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা ‘হ্রাস’ এবং ‘ধ্বংস’ করার পরিকল্পনা নিয়েই শনিবার রাতের হামলা চালানো হয়। গতকাল পেন্টাগনে এক ব্রিফিং তিনি বলেন, এ হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এ হামলায় কেউ হতাহত হয়নি বলেও তিনি দাবি করেন। হেগসেথ বলেন, ‘অনেক প্রেসিডেন্টই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে চূড়ান্ত আঘাত হানার স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু ট্রাম্প ছাড়া কেউই তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।’
ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পরমাণুকেন্দ্র রয়েছে ফোরদোয়। সেটি তেহরান থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ–পশ্চিমে, একটি পাহাড়ের নীচে অবস্থিত। এই কেন্দ্র মাটি থেকে অন্তত ৩০০ ফুট গভীরে। এই কেন্দ্রে হামলা চালানো সহজ নয়। একমাত্র আমেরিকার কাছেই এর উপযোগী অস্ত্র রয়েছে। ট্রাম্প লিখেছেন, ‘ফোরডো নিশ্চিহ্ন।’ কিন্তু কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ইরান তা স্পষ্ট করেনি। তারা আমেরিকার এই হামলার নিন্দা করেছে এবং জাতিসংঘের কঠোর প্রতিক্রিয়ার দাবি জানিয়েছে। ইরান এও জানিয়েছে, আমেরিকার হামলার পর পরমাণুকেন্দ্র সংলগ্ন অঞ্চলে কোনও তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হয়নি। ফলে জনগণ আপাতত সুরক্ষিত।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, ‘ট্রাম্প ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ– উভয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমাদের অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়বহুল ও অবিরাম যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন; তিনি আমাদের কূটনৈতিক অঙ্গীকারের অপব্যবহার করে কেবল ইরানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, বরং নিজের ভোটারদের প্রতারিত করেছেন। একজন যুদ্ধাপরাধীর মিশনে নিজেকে সমর্পণ করে ট্রাম্প মার্কিন জনগণের জীবন ও সম্পদকে ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার স্বার্থে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।’
প্রসঙ্গত, ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকা ইরানে হামলা চালাবে কিনা, সেই সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দু’সপ্তাহ সময় নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই মন্তব্যের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ইরানের তিন পরমাণুকেন্দ্রে চালালো আমেরিকা। তার পর থেকেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ট্রাম্প তাহলে দু’সপ্তাহের কথা বলেছিলেন কেন?
ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্ত মার্কিন সংবাদপত্র ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’–কে জানিয়েছেন, গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে একটি বৈঠকেই ইরানের হামলার বার্তা দিয়ে দিয়েছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সেই সময় তিনি চূড়ান্ত অনুমতি দেননি। ট্রাম্পের বার্তাতেই সকলে বুঝে গিয়েছিলেন, আমেরিকা হামলা করতে চলেছে ইরানে। সেই মতো বৈঠকের পরেই হামলার নীলনকশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একাংশের মত, গোটা বিষয়টি নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করাই লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পের। তাই তিনি দু’সপ্তাহের কথা বলেছিলেন। কিন্তু হামলায় ঠিক কয়েক ঘণ্টা আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের চূড়ান্ত অনুমতি মেলে। ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘উদ্দেশ্যটা ছিল– এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা, যা কারও মাথাতেই আসবে না।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলার পর ইসরায়েলে প্রায় ২০টি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। এসব ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব, হাইফাসহ ইসরায়েলের অন্তত ১০টি এলাকায় আঘাত হেনেছে, যাতে আহত হয়েছে ১৬ জন। ইসরায়েলের বেন গুইয়ন বিমানবন্দরকে নিশানা করেও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। বার্তা সংস্থা তাসনিম লিখেছে, বেশ কিছু গবেষণাকেন্দ্র, সহায়তা ঘাঁটি এবং বিভিন্ন স্তরের নিয়ন্ত্রণ ও কমান্ড সেন্টারকেও নিশানা করা হয়েছে। বিপ্লবী গার্ড বাহিনী জানিয়েছে, এই হামলায় তরল ও কঠিন জ্বালানি চালিত উভয় ধরনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
এদিকে পশ্চিম ইরানে সমপ্রতি চালানো হামলার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তারা জানিয়েছে, হামলায় খুজেস্তান প্রদেশের দেজফুল বিমানবন্দরে দুটি ইরানি এফ–ফাইভ জঙ্গিবিমান নিশানা করে তা ধ্বংস করেছে। রোববার সকালের হামলায় ইরানের আটটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি লঞ্চার ‘ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার জন্য প্রস্তুত’ ছিল বলে ইসরায়েলের ভাষ্য। এর আগে রাতে ২০টি ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান ইরানের কেন্দ্রস্থলের বহু স্থাপনায় আক্রমণ চালায়। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল– অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র, অস্ত্রের গুদাম এবং ইস্পাহান বিমানবন্দর।
বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ–নিন্দা, কূটনীতিতে সমাধান খোঁজার আহ্বান : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গত কিছুদিনের সংঘাত নতুন পর্বে পৌঁছাল। ইরানের বিরুদ্ধে তেল আবিবের অভিযানে ওয়াশিংটন সঙ্গী হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে পুরো অঞ্চলজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে তাই বিশ্বনেতাদের বেশিরভাগের মুখেই উদ্বেগ ও নিন্দার সুর শোনা গেছে। তারা উত্তেজনা প্রশমনে সব পক্ষকে সংযত হওয়ার পুরনো আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান খোঁজার কথাই বলছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে।
ইরানে মার্কিন হামলাকে ‘বিপজ্জনক উত্তেজনা’ বর্ণনা করে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এই সংঘাতের দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে গেছে– যার ফল সাধারণ জনগণ, এই অঞ্চল এবং পুরো বিশ্বের জন্য মারাত্মক হতে পারে।’ তিনি এঙ পোস্টে বলেন, ‘এই সংকটময় মুহূর্তে বিশৃঙ্খলার চক্র এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক সমাধান নেই। একমাত্র পথ কূটনীতি। একমাত্র আশা শান্তি।’
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘নির্লজ্জ’ লঙ্ঘন বলে বর্ণনা করেছে রাশিয়া। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “যতই যুক্তি দেখানো হোক না কেন একটি সার্বভৌম দেশের ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চালানোর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত– আন্তর্জাতিক আইন, জাতিসংঘ সনদ ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনের সরাসরি লঙ্ঘন।’
যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট আইন প্রণেতাদের অনেকে ইরানে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়াই এ হামলা চালানো হয়েছে। কংগ্রেস সদস্য আলেঙান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ বলেছেন, এটি সংবিধান এবং কংগ্রেসের যুদ্ধ ক্ষমতার ‘গুরুতর লঙ্ঘন।’ তিনি এটিকে ‘সম্পূর্ণ এবং স্পষ্টভাবে অভিসংশনের ভিত্তি’ বলে অভিহিত করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের হামলাকে ‘স্পষ্ট আগ্রাসন’ বলে বর্ণনা করেছে হামাস। এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বলেছে, এই হামলা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সরাসরি হুমকি। ইয়েমেনের হুতিদের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হেজাম আল–আসাদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বার্তায় যুক্তরাষ্ট্রকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটনকে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।’