হাফিজ, খৈয়াম, তাবরিজ, রুমি আর বসরাই গোলাপের দেশ ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমানে পশ্চিমাদের সামরিক অভিযান চলমান। এরকম বহু ষড়যন্ত্র বহু অভিযান তারা অতীতেও ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছে। যেমন সেরকম একটি অভিযান ছিল এরকম।
১৯৫১ সালে রাজনীতিবিদ, লেখক, আইনজীবী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক বিপুল ভোটে ইরানের ৩০ তম প্রধানমন্ত্রী র্ন্বিচিত হন। র্ন্বিাচিত হয়ে মোসাদ্দেক তার দেশের তেল সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি দেখেন তার দেশের তেল বিক্রয় লব্ধ মুনাফার মাত্র ১০% তার দেশ পায় বাকী পুরাটাই বৃটিশদের। তিনি যৌক্তিক মুনাফা ভাগাভাগির দাবী করলে বৃটিশরা তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। মোসাদ্দেক তার দেশের তেল ক্ষেত্র সমূহ জাতীয়করণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
প্রতিক্রিয়ায় বৃটিশরা ‘অপারেশন বুট’ নাম দিয়ে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুতির গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করে। অল্প দিনের মধ্যে ‘অপারেশন আজাক্স’ নাম দিয়ে আমেরিকান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাও মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুতির ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়। ১৯৫৩ সালের ১৯ আগস্ট আমেরিকার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ এবং বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এম সিক্স তেহরানের পথে পথে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। ফলাফল প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের পতন।
এর পর আমেরিকার যত প্রেসিডেন্ট এসেছেন তারা যখনই মনে করেছেন ইরান তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে পা রাখছে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে তখনই ইরানের উপর তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এমনকি বাইরে থাকা ইরানী অর্থও ফ্রিজ তথা অবরুদ্ধ করেছে।
ইরানের উপর পশ্চিমের এই শ্যেন দৃষ্টি বা এই বিরূপ মনোভাব কেন? এর মূল কারণ মধ্যপ্রাচ্যের উপর আমেরিকার একক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং মধ্য এশীয় দেশগুলির উপর প্রভাব বিস্তার থেকে ইরানকে নিবৃত্ত রাখা। এক্ষেত্রে ইসরাইল আমেরিকার বরকন্দাজ হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে, বিনিময়ে ইসরাইলের সকল পাপের এমনকি সাম্প্রতিকের গাজার লক্ষ মানুষ হত্যা, বেঁচে থাকাদের জন্য দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা, ক্ষুধার্ত মানুষদের সাহায্যের আশায় লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় গুলি করে যখন তখন মারা, লক্ষ্য বাড়িঘর ধ্বংস করে মানুষদের গৃহহীন করা, হাজার হাজার স্কুল কলেজ ধ্বংস করে গাজার ছাত্র–ছাত্রীদের শিক্ষা বঞ্চিত করা, হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করে মানুষকে চিকিৎসা বঞ্চিত করা, পশ্চিমতীর সহ বিভিন্ন স্থান থেকে ফিলিস্তিনিদের বাস্ত্তচ্যুত করা সব কিছুতে আমেরিকার বিনা বাক্যে সম্মতি এবং সর্মথন দেওয়া।
সাম্প্রতিক তথা এবার ১৩ জুন ২০২৫ ভোর রাতে ইরানের উপর যে অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয় তা সামরিক এবং গোয়েন্দা অভিযান দুটির যৌগ। এবার সরাসরি সামনে থেকে ইসরাইল এ আক্রমণ পরিচালনা করলেও পিছনে রয়েছে আমেরিকা। এই আক্রমনের পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ নিহিত আছে তার মধ্যে দি ডন পত্রিকার সাবেক সম্পাদক আব্বাস নাসির যথার্থই উল্লেখ করেছেন ‘ইরানে শাসক শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে ইসরাইল চায় সেখানে এমন এক সরকার আসুক যা পশ্চিমাদের জন্য মিত্র হিসাবে কাজ করবে, তারা তেল আবিবে’র সাথে বন্ধুত্ব করতে পারলে খুশি হবে। গাজা এবং পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের উপর চলমান জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে শুধু নিন্দা জানাবে’।
এর বাইরেও ইসরাইল তথা পশ্চিমারা ইরানের সামরিক সক্ষমতাকে ধ্বংস করার জন্য আক্রমণের প্রথম প্রহরেই ইরানী সামরিক কমান্ডের শীর্ষ ২০ জন কমান্ডারকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য দুর্বল সামরিক ব্যবস্থাপনার সুযোগে তারা ইরানের পারমানবিক স্থাপনাগুলি ধ্বংস করবে। সে লক্ষ্যে ইসরাইল এখন সেসব স্থাপনায় ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ইসরাইলীরা ইরানী র্শীষ ৬ পরমানুবিজ্ঞানীকেও হত্যা করেছে।
আমেরিকার মদদে ইসরাইলের ইরান আক্রমণের যুক্তি হল ইরানকে পারমানবিক চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত করানো যাচ্ছিল না।
অথচ ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ‘জে সি পি ও এ’ তথা ‘জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান’ এর মাধ্যমে ইরান পশ্চিমাদের সাথে একটি রফায় পৌঁছেছিল। কিন্ত্তু ইসরাইল চায়নি ইরান সসম্মানে সগৌরবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক। এ কারণেই ক্যাপিটাল হিলের ইহুদি লবী পি–৫ +১ অর্থাৎ জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য, আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য + জার্মানী কতৃক স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান থেকে আমেরিকাকে বেরিয়ে যেতে উস্কানি দেয় এবং শেষ পর্যন্ত সফল হয়।
‘জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান’ এ যে সমস্ত ধারা ছিল তা পাঠকের জন্য তুলে ধরছি:
ইরানের ইউরেনিয়াম মওজুদ ৯৮ পার্সেন্ট কমিয়ে ৩০০ কে জি তে নামিয়ে আনতে হবে এবং পরর্বতী ১৫ বছর এ অবস্থায় স্থিত রাখতে হবে। এই স্থিত মওজুদ ইউরেনিয়াম এর মান পারমানবিক অস্ত্র তৈরির সমদ্ধৃকরণ মান ৯০ এ নেওয়া যাবে না এবং তা ৩.৬৭ এ স্থিত রাখতে হবে।
‘নাথানজ’ পারমানবিক স্থাপনার ২০০০০ (বিশ হাজার) সেন্ট্রিফিউজ কমিয়ে, ৫০৬০ (পাঁচ হাজার ষাট) এ নামিয়ে আনতে হবে এটি ২০২৪ সাল পর্যন্ত বজায় রাখতে হবে। ফ্রাডো পারমানবিক শক্তি কেন্দ্রে ২০৩১ পর্যন্ত কোন প্রকার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ গবেষণা পরিচালনা করা যাবে না।
ইরান তার ‘আর্ক’ পারমানবিক স্থাপনা রি ডিজাইন করতে সম্মত হয়। এই রি ডিজাইন এর ফলে এখানে কোন প্রকার পারমানবিক অস্ত্র তৈরি করা যায় সেরকম প্লুটুনিয়াম উৎপাদন ব্যবস্থা থাকবে না। ইরান পারমানবিক জ্বালানী সমৃদ্ধকরণ উদ্দেশ্যে আর কোন স্থাপনা নির্মাণ করবে না।
ইরান, আই এ ই এ (ইন্টারন্যশনাল এ্টমিক এনার্জি এজেন্সি) কর্তৃক তার পারমানবিক স্থাপনা পরিদর্শনের ইচ্ছে পোষণ করলে ২৪ (চব্বিশ) দিনের মাথায় তা করতে দিতে সম্মত হয়।
জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান এর বলে ইরান তার অবরুদ্ধ ১০০ (একশত) বিলিয়ন ডলারের ব্যবহার, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী রপ্তানী এবং গ্লোবাল ফাইনেন্সিয়াল সিস্টেমের মাধ্যমে লেনদেনের সুযোগ পাবে।
১৬ জানুয়ারি ২০১৬ আই এ ই এ (ইন্টারন্যশনাল এ্টমিক এর্নাজি এজেন্সি) ইরান জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান এর সব ধারা পূরন করেছে বলে নিশ্চিত করে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ চুক্তি অনুমোদন করে, ইতিপূর্বে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ‘জে সি পি ও এ’ তথা ‘জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান’, এড্যাপশান ডে বা গ্রহণের দিন হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসের পাতায় সীমাহীন কলংক লেপন করে পরবর্তী আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম ‘জে সি পি ও এ’ থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নেয়।
এর পরের ইতিহাস ইরানের অর্থনীতি রাজনীতি সব কিছুর উপর একের পর এক হস্তক্ষেপ। সেটি কোন কোন ক্ষেত্রে সরাসরি আমেরিকা কর্তৃক আবার কোন কোনটি ইসরাইল কর্তৃক আবার কোন কোন ক্ষেত্রে যৌথভাবে।
ইরানও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। সৃষ্টি করে বিভিন্ন ‘প্রক্সি’ বা অনুগত যোদ্ধার দল। এর মাঝে লেবাননে হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনে হামাস, ইয়েমেনে হুতি, ইরাকে সশস্ত্র গোষ্ঠী।
এমন এক প্রেক্ষাপটে পুনরায় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট র্ন্বিাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে আলোচনার দ্বার উন্মোচন করেন। বিশ্বের নানা দেশে আমেরিকা এবং ইরানের মধ্যে অপ্রত্যক্ষ আলোচনা চলতে থাকে। ৫ম আলোচনা শেষে ওমানের রাজধানীতে ১৫ জুন ২০২৫ ৬ষ্ঠ আলোচনার দিন নির্দিষ্ট ছিল।
আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ইরান বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইরানের সাথে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকের পূর্বে উল্লেখ করেন আমেরিকার সাথে ইরানের যেকোন চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্ব শর্ত হিসাবে তেহরানকে অবশ্যই তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এবং পারমানবিক কর্মসূচী বাতিল করতে হবে, নিউইয়র্ক টাইমস এ খবর প্রকাশ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরগাছি উল্লেখ করেন ‘উইটকফ’এর কাছ থেকে আমরা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য শুনছি, আমরা আমাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ নিয়ে সম্ভাব্য উদ্বেগের বিষয়ে আস্থা তৈরি করতে প্রস্ত্তুত, তবে সমৃদ্ধকরণ আলোচনাযোগ্য নয়’।
এই ‘সমৃদ্ধকরন আলোচনাযোগ্য নয়’ এর মাঝেই ইসরাইল এবং আমেরিকা ইরান আক্রমণের খোড়া যুক্তি খুঁজে নেয়।
বর্তমানে ইসরাইল–ইরান হামলা পাল্টা হামলা চলছে। আমেরিকা তার শক্তির হাত ইসরাইলের দিকে বাড়িয়ে রেখেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থানরত তাদের রণতরীকে মধ্যপ্রাচ্য অভিমুখে যাত্রার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট তেহরানবাসীকে কানাডা থেকেই তেহরান ত্যাগের হুমকি দিয়েছেন, কানাডা’র জি–৭ সম্মেলন থেকে একদিন বাকী রেখেই তিনি ওয়াশিংটনে ফিরে হোয়াইট হাউজে জাতীয় নিরাপত্তা বলয়ের জরুরি সভা ডেকেছেন।
ইরানের পাশে বিবৃতি ছাড়া আপাতত দাঁড়ানোর তেমন কেউ নেই। এখন দেখা যাক ইরানীরা স্বীয় শক্তিতে পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেয়। (চলবে)।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।