শতাব্দি পেরিয়ে, দূর প্রান্ত রেখায় মানুষ নিজেকে খোঁজে। প্রকৃতির কাছে সমাপিত হবে জেনেও নিজের চিহ্ন রেখে যাওয়ার বাসনায় যাপন ও যন্ত্রণা দুই থাকে। হুবুহু রেখে না গেলেও, বিবর্তিত স্বভাব থাকাই ন্যায্য। আপাতত মিথ্যেও নয়। কিন্তু যথেষ্ট সঞ্চালনের পরেও তার প্রতি প্রজন্ম হারিয়ে ফেলে কিছুটা। এ হারানো সম্পূর্ণ মন্দ নয়। তবে কিছুটা দায়সারা।
প্রজন্মের পর প্রজন্মে চিহ্ন রাখার অন্যতম হাতিয়ার নিজের সীমানা নির্ধারণ। সীমানা ফলে মুক্তির গল্প বলে, বলে যুদ্ধেরও। টিকে থাকার লড়াইতে যুদ্ধ এবং ভালোবাসার কোনো কাঠগড়া থাকে না। পুরানো আলাপকে উপেক্ষা করে সামনে আগানো সম্ভব নয়। বর্তমানে স্বাধীনতা অর্জন এবং রক্ষা উভয়ই পরিশ্রমের দাবি রাখে। সত্যের দাবি রাখে। সীমানার আওতায়, নিজের জন্ম–ভূখণ্ডের স্বাধীনতার দাবি তাই প্রথম শর্ত।
যে ভূখণ্ড একান্ত নিজের, আত্মার কাছাকাছি তার প্রতি অন্যায় সয়ে যাওয়া দুষ্কর। আর ইতিহাসে এমন দুষ্কর অভিযানের গল্প কালে–ভদ্রে শুধু রূপকথাই হয়ে রইলো। ফলে কবি জানেন, আমরা কেউই বাঙালি জাতির ইতিহাস ঠিকঠাক আত্মস্থ করিনি। তাই বলে ভুলে যাবার সরল স্বীকারোক্তিও মেনে নেওয়া যায় কি?
দুশো বছরের উপনিবেশে বাঙালির প্রবল ক্ষতি হলো, নেপথ্যে যে আমাদের দেশীয় মগজের দায়সারা স্বভাব নেই তা তো নয়। নেপোলিয়ান আমেরিকা আবিষ্কারের পূর্বে কি সেখানে মানুষের জন্ম হয়নি? মহাত্মা গান্ধী না বললে কি ভারতীয়রা জানতেন না তারা ভারতীয়? পাকিস্তান তার সীমানা নির্ধারণ করলেই আমার মায়ের গর্ভে নিশ্চয় ঊর্দুর ভাষার দীক্ষা দেয়নি? আমরা তো বাঙালি, সংকর। দেখা যায়, শত মানুষের দিনের পর দিন সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা একজনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। যদিও সে একজনের প্রতিবাদেই সে শত জীব(মানুষ) বুঝতে পারেন তারা আর প্রাইমেট নেই, বিবর্তিত হয়ে কিছুটা মানুষ হয়েছেন। নিজের বলেও কিছু আছে তাদের।
পলাশীর প্রান্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের বন্দরে বাঙালি তো যুদ্ধ করেছে, হেরেছেও কখনো। ২৫ মার্চ কালরাত্রির দামামা তো থামেনি এখনো। যুদ্ধের ন্যারেটিভই এমন, এখানে থামার কোনো জায়গা থাকে না। প্রতি যুগে যখনই অন্যায়ের চাবুক পড়েছে গা’য় ততবারই বাঙালি এগিয়েছে যুদ্ধে। তবে মাহরাং বালোচ কোন বাঙালিদের কথা বললেন?
বেলুচিস্তান এশিয়ার অন্যতম ঐতিহাসিক অঞ্চল। পরিবারের মেজ সন্তানের মতো। পাকিস্তানের দক্ষিণ দুয়ার, ইরানের পুবের হাওয়া আর আফগানিস্তানের দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে পর্বতের রাজকীয় ভূমি সে। পারস্যের পারিবারিক শাসনে বেড়ে ওঠা পরবর্তীতে মোঘলের অধীনস্থতা, আফগানিস্তানের অংশ করা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ভোট গিয়ে পড়ে পাকিস্তানে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্মে স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা এবং নিজস্ব ভাবনার জাগরণই তাদের ভূখণ্ডের দাবিকে আরো জোরদার করেছে। বর্তমানে বেলুচিস্তানের দখলকে আরো পাকাপোক্ত করতে পাকিস্তান ঠিক একাত্তরের মতই নির্বিচারে গ্রেফতার, আটক, হত্যা চালায়। ১৫০ জনের বেশি মানবাধিকার কর্মীকে গুম করা হয়। ভারতের সাথে পূর্ব–যুদ্ধের রেশ আবারো যখন তুঙ্গে তখনই এ বছরের ৯ মে মাহরাং বালোচসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
পূর্বে ২০০৯ সালে মাহরাং বালোচের বাবা যিনি বালুচের মানবাধিকার লড়াইয়ের অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা আবদুল গাফফার, তার নিখোঁজ সংবাদের তিন বছরের পর মাহরাং–এর মুঠোফোনে খবর আসে বাবার লাশ গ্রহণের জন্য। ২০১৭ সালে তার ভাইকেও নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নিয়ে তিনমাস আটকে রাখে। বালুচের মানুষের এমন দশা থেকে মুক্তি পেতেই মাহরাং সিদ্ধান্ত নেন, তিনি লড়বেন। যথেষ্ট গুম, খুন, ধর্ষণের হুমকি পেয়েও মাহরাং থেমে যাননি। বর্তমানে বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি।
বেলুচিস্তানকে একটি ‘গণতান্ত্রিক’ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেন মাহরাং। জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতি চান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন এবং বেলুচ নারীদের সরকার প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুতি দেন। স্বাধীনতার ঘোষক মাহরাং–কে বেলুচিস্তানের জনগণ নিশ্চয় মনে রাখবেন। জানা নেই, মাহরাং এবং বেলুচিস্তানের এই স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাসে বাংলাদেশীরা কিছু স্মরণে আনতে পারছেন কিনা?
বর্তমানে কোনো খবর ট্রেন্ডিং না হলে, খুব সহজে তার প্রভাব নিয়ে আমরা চিন্তিত হই না। দুর্ভিক্ষের কালে শত দেশীয় প্রেমে গা ভাসানো নিউজ ফিডে কিন্তু একটাই ভিডিও, এক কথায় ভাইরাল হয়ে আছে। ‘ইয়ে বাঙাল নেহি, ইয়ে বেলুচিস্তান হে… হাম আপনে শাহিদোকো কাভি নেহি ভুলেঙ্গে’। অর্থাৎ ‘এটা বাঙাল না, এটা বেলুচিস্তান। আমরা আমাদের শহীদদের কখনো ভুলব না’……
মহাভারতের ঐতিহাসিক বক্তব্য হলো, রাবণকে আদতে রাম হারায়নি, হারিয়েছিলো বিভীষণ। অর্থাৎ ঘরের বিড়ালই, ঘরের রাস্তা কাটে। বিভীষণ থেকে মীর জাফর কেউই আর ঘৃণার বাইরে রইলেন না। কিন্তু আমরা ঠিকমতো ইতিহাস কিংবা মহাভারত কোনোটিই পড়িনি, আমাদের পড়ার ইতিহাস খুবই নগন্য প্রায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের, শহীদেরা বীরশ্রেষ্ঠ। এই ইতিহাসকেও সঠিক পাঠ দেওয়া হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশীয় রাজনীতিতে টালমাটাল অবস্থা সামাল দেওয়াই মোক্ষম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সময়ের সাথে আমরা উঠেও এসেছি, পরিত্রাণ পেয়েছি অনেক ধস থেকে। কিন্তু টানা শোষণ থেকে মুক্তি পেতে আবারও ছাত্র জনতা তাদের বজ্রকণ্ঠ উত্থান করলে, শত সাধারণ শিক্ষার্থীই ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও বাংলার ইতিহাসে বেহাত হতেই বোধহয় আন্দোলন হয়, যুদ্ধ হয়। লাশের উপচে পড়া ভিড়কে টপকিয়ে, বেচাকেনা করে পূর্বের ন্যায় এবারও ব্যবসা জমজমাট প্রায়। রসিকতার ছলে দুটো কথা লিখি–এক. ভারত আবিষ্কার মশলায় আর চট্টগ্রাম আবিষ্কার ব্যবসায় একই সূত্রেই গাঁথা। দুই. ১৪ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনী জানতো তাদের হারা নিশ্চিত কিন্তু তারা ফর্দ করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেন যার পরিণত দশা আজকের বাংলা। বাদবাকি কোনো ব্যাখ্যাই বাহুল্যতা।
শহীদদের রক্তের নেশায় মগ্ন জাতি আমরা, মাহরাং ফলে আমাদের কথাই বলছেন। আমাদের ভুলে যাওয়া বিবেক, ভুলে যাওয়া যুদ্ধ, ভুলে যাওয়া সকল ইতিহাসকে এক বাক্যে মাহরাং বলেছেন। এটা বাংলা নয়। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের শহীদেরা দেখেছেন সে বাংলাদেশ এটি আর নেই। যুদ্ধপরাধীদের মুক্তি, বন্দরে বিদেশী সীমানা, পথে–ঘাটে নারীর নিরাপত্তাহীন বাংলাদেশ এটি। মাহরাং এ বাংলার কথাই বলছেন। আজ থেকে দুশো বছর পর স্পষ্টত, ফিলিস্তিন কিংবা বেলুচিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একদিন মুক্তি পাবেই, তাদের শহীদদের কথাই বিশ্ববাসী শুনবে কিন্তু তখন ইতিহাসে কোনো বাংলাদেশ থাকবে কিনা অনিশ্চিতই বটে। বিশ্ববাসী জানবেন, আফগানিস্তানের মতোই বাংলাদেশে জঙ্গির উত্থান হয়েছিলো, বাংলায় সব শাসকেরই সুইচ ব্যাংকে নামডাক ছিল, সাধারণ জনগণ তার স্বাভাবিক জীবন ছেড়ে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের ম্যাটিকুলাস ট্রেনে চড়েছিল। বেনামি লাশগুলোর ঠিকানা শহীদের কৌটায় ছিলই কিন্তু পূর্বের ন্যায় মুছে দেওয়া হয়েছে শুধু। হ্যাঁ মাহরাং এই বাংলাদেশের কথাই বলছেন। মাহরাং আমাদের কথাই বলছেন। মাহরাং আমাদের মুক্ত বাতাসের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।