ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে আক্রান্ত হয়েছে ইসরায়েলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সদরদপ্তর। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাসনিম’র প্রকাশিত কিছু ছবিতে মোসাদ–এর সদরদপ্তরে আগুন দেখা যাচ্ছে। ইরানের রেভ্যলুউশনারি গার্ড বিষয়টি জানিয়েছে। সংবাদ সংস্থাটি জানায়, সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও আইআরজিসি অ্যারোস্পেস ফোর্স ফাইটাররা একটি কার্যকর অভিযানে সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্রে আঘাত করেছে। তবে মোসাদ কার্যালয়ে হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের দিক থেকে এখনো কোনো মন্তব্য আসেনি। এসব বিষয়ে সরকারি যে বিধিনিষেধ আছে তাতে ইসরায়েলের সংবাদ মাধ্যম কিছু নির্দিষ্ট স্থাপনা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে না।
এদিকে, ইসরালেয়ে আগামী কয়েক ঘণ্টায় নতুন ও উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করে তীব্র হামলার নতুন ঢেউ চালাবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইরান। গতকাল মঙ্গলবার ইরানের স্থলবাহিনীর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিওমারস হেইদারি বলেছেন, তেল আবিব ও হাইফা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং ব্যাপক ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পন্ন শত শত দীর্ঘপাল্লার ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেইদারি বলেন, শত্রুপক্ষের জানা উচিত সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে স্থলবাহিনী নতুন ও উন্নত অস্ত্র দিয়ে তীব্র হামলার নতুন পর্ব শুরু করেছে এবং তা আগামী কয়েক ঘণ্টায় আরও তীব্র হবে। সোমবার ইরানি সামরিক বাহিনী ‘শাহেদ ১০৭’ নামে একটি নতুন আত্মবিধ্বংসী ড্রোন উন্মোচন করেছে, যার হামলার সক্ষমতা দাবি করা হয়েছে ১৫০০ কিলোমিটার। এই ড্রোনটি চলমান সংঘাতে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ইরানের আকাশ আমাদের দখলে : ইরানে ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত না থাকার ঘোষণা দিলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার বলেছেন, ইরানের আকাশ এখন পুরোপুরি এবং সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ওদিকে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কোথায় লুকিয়ে আছেন তা জানেন দাবি করে ট্রাম্প বলেছেন, এখন আমরা তাকে মারব না। গতকাল মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে ট্রাম্প ইরানের আকাশ দখলে নেওয়া এবং খামেনিকে নিয়ে একথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন থেকেই ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে এবং সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করে আসছে। কিন্তু গত শুক্রবার ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে ট্রাম্প প্রশাসন বরাবারই প্রকাশ্যে বলে এসেছে তারা এই হামলায় জড়িত নয়। এই আবহে স্যোশাল মিডিয়া পোস্টে ট্রাম্প তার মন্তব্যে বহুবচনে ‘আমাদের’ এবং ‘আমরা’ শব্দের যে ব্যবহার করেছেন তা চমকে দেওয়ার মতো। ট্রুথ স্যোশালের পোস্টে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি সামরিক সাজসরঞ্জাম নিয়েও বড়াই করেছেন ট্রাম্প। তিনি লেখেন, ইরানের আকাশ নজরদারির ভাল প্রযুক্তি ও প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ছিল। কিন্তু সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সরঞ্জামের সঙ্গে তুলনীয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ভাল আর কেউ এটা করতে পারে না। ইরানের আকাশ সোমবার দখলে নিয়েছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত হানে তারা। কিন্তু ট্রাম্প এই সাফল্যের প্রশস্তি গেয়েছেন ইরানের আকাশ ‘আমাদের’ নিয়ন্ত্রণে বলার মধ্য দিয়ে।
আবার ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রসঙ্গেও ট্রাম্প ট্রুথ স্যোশালে লেখেন, আমরা ঠিক জানি তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন। তিনি সহজ লক্ষ্যবস্তু, কিন্তু সেখানে নিরাপদ – আমরা তাকে বের করে (হত্যা!) আনবো না, অন্তত এখনই নয়। কিন্তু আমরা চাই না বেসামরিক নাগরিক বা আমেরিকান সৈন্যদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ হোক। আমাদের ধৈর্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই পোস্টের পরপরই তৃতীয় আরেকটি পোস্টে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লিখেছেন, ‘আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার!’ (নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!)।
গত রাতে ইরানের আরও একজন সিনিয়র সামরিক কমান্ডারকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। আইডিএফ বলছে, ইরানের সামরিক বাহিনীর নতুন শীর্ষ কমান্ডারের নাম আলী শাদমানি। আর ইরান সর্বশেষ হামলায় ইসরায়েলে ৩০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে বলে দাবি করেছেন ইসরায়েলের কর্মকর্তারা। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদোন সা’র বলেছেন ইরানের সরকার পরিবর্তন করা ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য নয়। তিনি বলেন, অভিযানের ফলে এটি ঘটতে পারে, কিন্তু এটি তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য হলো ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস ইন ইরান বা এইচআরএএনএ জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৪৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে ইরানে। নিহতদের মধ্যে ২২৪ জন বেসামরিক নাগরিক বলেও সংস্থাটি জানিয়েছে।
নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা : জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণ সংস্থা (আইএইএ) বলছে, তারা ইরানের নাতাঞ্জ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ অংশে ‘সরাসরি প্রভাব’ পড়ার লক্ষণ দেখতে পাচ্ছে। তবে ইসফাহান পরমাণু কেন্দ্র বা ভূগর্ভস্থ ফর্দো সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টে কোনো পরিবর্তন তাদের নজরে আসেনি। দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাজেন্সি (আইএইএ) বলছে যে তারা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করেছে। শুক্রবার ইসরায়েলের হামলার পর এসব ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। শুক্রবার ইরানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। নাতাঞ্জ ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট (এফইপি) হচ্ছে ইরানের সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র যা ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়। যেখানে পরীক্ষামূলকভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হয়। এই দুটি ইউনিটেরই অবস্থান মাটির নিচে, বিশেষ সুরক্ষা দিয়ে তৈরি যাতে বিমান হামলার আঘাত থেকে বাঁচানো যায়। এই কেন্দ্রটিতে তিনটি বড় ভবন রয়েছে যার সবগুলোই মাটির নিচে নির্মিত । শুক্রবারের হামলায় এই কেন্দ্রের ‘অনেক ক্ষতি’ হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
এদিকে ইরানের সাইবার সিকিউরিটি কমান্ড এক ঘোষণায় ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ওই ঘোষণায় স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ, পোর্টেবল কম্পিউটারসহ কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কে যুক্ত ডিভাইস ব্যবহার কর্মকর্তা ও সিকিউরিটি টিমগুলোর জন্য নিষিদ্ধ বলে জানানো হয়েছে। ইরানের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সেপাহ বড় ধরনের সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। এ হামলার কারণে ব্যাংকটির অনলাইন সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির আধা–সরকারি সংবাদ সংস্থা ফার্স। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা করছে। ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট একটি হ্যাকিং গ্রুপ ‘প্রিডেটরি স্প্যারো’ বা ফারসিতে ‘গোনজেশকে দারান্দে’ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা দাবি করেছে, এই সাইবার হামলায় তারা ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ ডেটা ধ্বংস করে দিয়েছে। চলমান ইসরায়েল–ইরান উত্তেজনার মধ্যে এ ধরনের সাইবার হামলা নতুন করে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
নিন্দায় ২১ আরব–মুসলিম দেশ : ইরান–ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত টানা পঞ্চম দিনে পড়ল। গত শুক্রবার ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। এরপর ইরানও পাল্টা হামলায় নামে। দুই দেশ পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে ২১টি আরব ও মুসলিম দেশ যৌথ বিবৃতি দিয়েছে। একইসঙ্গে তারা আঞ্চলিক উত্তেজনা কমানো, নির্বিচারে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানিয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে অংশ নেওয়া দেশগুলো হলো–তুরস্ক, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, বাহরাইন, ব্রুনেই, চাদ, গাম্বিয়া, আলজেরিয়া, কোমোরোস, জিবুতি, সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া, ইরাক, ওমান, কাতার, কুয়েত, লিবিয়া, মিসর ও মাউরিতানিয়া। বিবৃতিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েলের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেন। তারা জাতীয় সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ওপর গুরুত্ব দেন এবং বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান চান।
মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রাশিয়া : ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত বন্ধে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রাশিয়া। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ এ কথা জানিয়েছেন। নিয়মিত ব্রিফিংয়ে পেসকভ বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত বন্ধে প্রয়োজনে রাশিয়া মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেছেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি অর্থাৎ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি বন্ধ করতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আরও ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলছেন, ইরান বেসামরিক কাজে ব্যবহারের চেয়ে বেশি মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ট্রাম্পের প্রশংসা করে বলেছেন, অস্ত্র বিস্তার রোধের বাধ্যবাধকতা ইরান যেভাবে লঙ্ঘন করেছে তার পক্ষে একটিও যুক্তি নেই। ট্রাম্প আমেরিকার সামরিক বাহিনীকে শুধু আমেরিকান জনগণের লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার করতে আগ্রহী।
অপরদিকে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাই জি–৭ নেতাদের সমালোচনা করে বলেছেন, তারা ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসন, শান্তিপূর্ণ পরমাণু স্থাপনায় অবৈধ হামলা ও ইরানের নাগরিকদের হত্যার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।