অপার সম্ভাবনার পটিয়ার পূর্ব হাইদগাঁও গ্রাম

রশীদ এনাম | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপা লীলাভূমিক পূর্ব হাইদাঁও এলাকা। সুফি সাধকদের এলাকা সাতগাছিয়া দরবার শরীফ। শ্রীমতি খাল এবং সবুজ অরণ্যে ঘেরা। হযরত আকবর শাহ ও কাজী হামিদ উদ্দিন গৌড়ী স্মৃতি বিজড়িত হাইদগাঁও। পটিয়া সদরের উত্তর পাশে হাইদগাঁও এর অবস্থান। পটিয়া সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে সাদা মাটির পাহাড়রে অবস্থান। সাদা মাটির পাহাড়ে যেতে হলে পটিয়া সদরের ডাকবাংলোর সামনে থেকে শেলুচালিত টেম্পু বা সি এনজি নিয়ে মাহাদাবাজ গ্রাম পূর্ব দরগাহ গেইট নামতে হবে।

হাইদগাঁওর নামকরণও বেশ সুন্দর। ভৌগলিক দিক দিয়ে পটিয়ার প্রকৃতির সৌন্দর্যের আধার। হাইগাঁও পাহাড়ি এলাকায় ছিল হাতির অভয়ারণ্য। হাতি চলাচলা করতো বলে অনেকে এই গ্রামকে বলতো হস্তী গ্রাম। চট্টল গবেষক এ নুরুল হক লিখেছেন, চক্রশালা ধর্মশালা স্থাপন শেষে বুদ্ধদেব এক গ্রাম থেকে হস্তীতে চড়ে কুশী নগর গিয়েছিলেন, এতে গ্রামটির নাম প্রথমে হস্তীগ্রাম এবং পরে হাইতগাঁও বা হাইদগাঁও হয়। তবে অনেকে বলেন, হামিদ উদ্দিন গৌড়ি প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে তাঁর নামে হাইদগাওঁ গ্রামের নামকরণ হয়।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর পটিয়া হাইদগাঁও পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে বুদবুদ বা বুদবুদি ছড়া যে জায়গায় সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের খনি। পাহাড়ি অরণ্য, যেখানে রয়েছে ফলজ, বনজ ঔষধি বৃক্ষরাজি। অবকাশ যাপনের ভ্রমণ পিয়াসীরা ছুটে যায় পূর্ব হাইদগাঁও মুজিব নগর এলাকায়। শ্রীমাই খাল শ্রীমতী রানির নামানুসারে শ্রীমাই পাহাড়। শ্রীমাই পাহাড় থেকে শ্রীমাই খালের নামকরণ।

পটিয়া শ্রীমাই পাহাড়ে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে এলুমিনিয়াম সমৃদ্ধ সাদা মাটি (চায়না ক্লে)। তা পরিশোধিত করে চায়না ক্লের পরিবর্তে বিভিন্ন কেমিক্যালের বা পদার্থের সংমিশ্রনে উন্নতমানের ক্রোকারিজ উৎপাদন করতে পারে। একদিন হাইদগাঁও এলাকায় অরণ্যে বিহারে বেরিয়েছিলাম সাদা মাটির পাহাড়ের সন্ধানে। পূর্ব হাইদগাঁও হয়ে একেবারে গভীর অরণ্যে গিয়ে পৌঁছলাম। সাদা মাটির পাহাড়াটি কোথায় অনেক সঠিক বলতে পারছে না। পরবর্তীতে খুঁজ পেলাম সাদা মাটির পাহাড় পূব হামিদ গাঁও ও কেলিশহরের অদূরবর্তী গভীর অরণ্য। সাদা মাটির গভীর অরণ্যে হওয়াতে অনেকে যাওয়ার সাহস করে না। বর্ষামৌসুমে হাতির পাল দেখা যায়। আমরা যখন সাদা মাটির পাহাড়ের কাছে প্রবেশ করলাম। ভয়ে গ গা ছমছম করছে। সাদা মাটির পাহাড়ি এলাকাটা সত্যি অপরূপ। পৌষী সকাল গড়িয়ে বেলা ১২টা রোদ বেশ উঠেছে। সাদা মাটির জঙ্গলে গাছগুলোর সবুজ নরম গায়ে সোনাঝরা রোদ লেগেছে। আকাশটা দারুণ নীল। ঘাসের পাতায় শিশির পড়ে ভিজে রয়েছে রোদ পড়াতে ঝলমল করতে লাগল। হাত দিয়ে স্পর্শ করাতে ঘাসগুলো কেমন জানি লজ্জায় নেতিয়ে পড়লো।

প্রকৃতি থেকেও মানবজাতির অনেক কিছু শেখার আছে। পাহাড়, গভীর অরণ্য নাকি বড়ো শিক্ষক। পাহাড় শিক্ষা দেয় ধৈর্য, একাগ্রতা এবং মূল্যবোধের। বৃক্ষ শিক্ষা দেয় বিনয়ী ও নত হওয়ার। বাঁশ বাগান কিংবা যে বৃক্ষ যতো আকাশ ছুঁতে চাই সেই বৃক্ষের ডালা কিন্তু নুইয়ে পড়ে।

পূর্ব হাইদগাঁও থেকে যে রাস্তা উত্তর পশ্চিম দিকে চলে গেছে ঐ মেঠো পথ ধরে হাঁটা আরম্ভ করলাম পাহাড়ি আকাঁ বাঁকা পথ।

একটু সামনে গেলে বটতলী মাঠ দুপাশে পাহাড় সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সামনে হেঁটে গেলে চোখে পড়বে ডেবার পাহাড়। তার পাদদেশে এক সময় গ্রাম ছিল। হাতির তান্ডবে এখানে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। হাতির পাল নেমে মানুষের বাড়ি ঘর লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে। তারপর থেকে জনমানব শুন্য হয়ে পড়ে। পাহাড়ি অরণ্য যাওয়ার সময় সাথে ছিল গ্রামের আবুল বাশার, সুহৃদ রাসেল। বাশারের বাড়ি পূর্বহাইদগাও গ্রামে। পাহাড়ে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে খুব সাহসী প্রকৃতির। সে জানালো, পাহাড় থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আসার সময় একবার হাতির পালের সামনে পড়েছিল। হাতিকে নাকি “ম” বলে রক্ষপেয়েছিল” পাহাড়ি এলাকার লোকেরা হাতিকে “ম” (মামা) বলে সম্বোধন করেন।

মাটি খুঁড়ে ঘরের কিছু ভগ্নাবশেষ চোখে পড়ল। আরেকটু দূরে হেঁটে গেলে চোখে পড়বে চমৎকার শুভ্র বর্ণের অপরূপা মাটির পাহাড়। মাঝে মাঝে কয়লা চোখে পড়বে। শুভ্র মাটির পাহাড়ে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। এ পাহাড়ে রয়েছে হাজার ফলজ বনজ ও ঔষধি গাছ। শুভ্র মাটির পাহাড়ে পাদদেশে মাঝে মাঝে হাতির পাল, বন্যপশু, সাপের ভয়ে লোকজনেরা আতঙ্কে থাকেন।

সাদা মাটির পহাড় থেকে কয়লা আর পাহাড়ি শিলা পাথর সংগ্রহ করলাম। আবুল বাশার জানান, পাহাড়খেকোরা “সাদা মাটির পাহাড় অনেকে চুরি করে মাটি বিক্রি করেছে। অনেকে জানতো না এ মাটি কত মূল্যবান। সাদা মাটির পাহাড়ে রয়েছে ফসফরাস জাতীয় পদার্থ। এ পাহাড়ে বেশ গন্ধকও রয়েছে। সরকারিভাবে এ খনিজ সম্পদ সংগ্রহ কও বে্যবাহারের উপযোগী করা গেলে অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হতো। বিদেশে থেকে অর্থ ব্যয় করে খনিজসম্পদ আমদানি কিছুটা কমে যেত।

প্রকৃতির আধার পটিয়ার সৌন্দর্যরানি পূর্ব হাইদগাঁও এর মুজিবনগর এলাকাটি সবুজ শ্যামল চিরহরিৎ ক্ষেত্র। যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে। শরৎকালে পেঁজাতুলো মেঘের ভেলায় আকাশ থাকে গাঢ় নীল, পাহাড়ের পাদদেশে শস্যখেতে সবুজ ধানের ফসলি জমিতে ধানের উপর মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলে যায়। পাহাড়ি বনে নানা জাতের বৃক্ষরাজিতে পাখিরা মধুর সুরে গান গায়। বৈকালে অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা অপার পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ছুটে আসেন। এলাকায় আসলে যে কারও গাইতে ইচ্ছে করবে, “পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি;/ গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে,/ তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে;/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ ও সে সকল দেশের রানী সে যেআমার জন্মভূমি। পটিয়ার প্রকৃতির অপরূপ সুন্দর পূর্ব হাইদগাঁও এর মুজিবনগর এলাকায় আগামীতে হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় মিনি পর্যটন নগরী ও ইকো ট্যুরিজম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফেয়ারওয়েল ব্রুনো, ফেয়ারওয়েল এনজো
পরবর্তী নিবন্ধব্লাড ফর চিটাগাং ও ধ্রুবতারার মাস্ক বিতরণ