দূরের দুরবিনে

রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়িতে আক্রমণ : কিসের ইঙ্গিত?

অজয় দাশগুপ্ত | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:৩০ পূর্বাহ্ণ

২০২৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাচারি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা ৮ জুন, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলায় সংঘটিত হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত এই কাচারি বাড়িতে দর্শনার্থী ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে বিরোধের জেরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে এক দর্শনার্থীকে আটকে মারধরের ঘটনায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (১০ জুন) দুপুরে কাছারি বাড়ির অডিটোরিয়াম ও কাস্টোডিয়ানের অফিস কক্ষে দরজাজানালায় ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা।

ঘটনাটি কতটা পরিকল্পিত বা রবীন্দ্র বিরোধিতাজনিত তা আমরা জানি না। তবে যে কোন ঘটনাকেই একপেশে করে তোলায় আমাদের জুড়ি নাই। তাই সেদিকে খেয়াল রেখেই বলছি এমন একটা ঘটনা না ঘটলে কি হতো না? এমনিতেই সমাজ অশান্ত। একদল মানুষ সে অশান্তির কারণ আর একদল সমর্থক। এই বাস্তবতায় আমরা কেন এমন ঘটনা দেখব?

বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথ বিপদে আছেন। ক’দিন পরপর তাঁর লেখা জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়। ভাবখানা এই যে তিনি এমনটা বলে গিয়েছিলেন, আমার গান জাতীয় সঙ্গীত না হলে আমি খুব কষ্ট পাবো। আরো আছে। তারুণ্যকে রবীন্দ্র বিরোধী করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরোধিতার মুখরোচক গিতল্পের শেষ নাই। স্বনাম ধন্য বেনামী বদনামী কত বুদ্ধিজীবী। সব এক পায়ে খাড়া। বাংলা বাঙালি আর রবীন্দ্রনাথ যে এক ও একক সেটা তারা বোঝেন। বোঝেন বলেই যে কোন উপায়ে রবীন্দ্রনাথের নির্মুল বা উচ্ছেদ চায় এরা। এ ঘটনার সাথে সে সব কাইনীর যোগ আছে এমনটা বলছি না। কিন্তু একটা কথা ভাবতে বা বলতে বাধ্য হচ্ছি।

যখন আপনি লোহা পিটাতে পিটাতে তার মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবেন তখন দুর্বল মানুষ ও তা বেঁকিয়ে ফেলতে পারবে। বাঁকিয়ে বিকৃত আনন্দ লাভ করবে। কাচারি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের চৌদ্দ পুরুষের কেউ থাকেন না। এটি তাঁর জমিদারী আমলের নিদর্শন। ইতিহাস বলছে:

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পুরাকীর্তি হচ্ছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ি। এটি রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাচারি ছিল। তারও পূর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি নীলকরদের নীলকুঠি ছিল। সে কারণে এখনও অনেকে একে কুঠিবাড়ি বলে। পরে রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি নিলামে কিনে নেন। এখানে রয়েছে জমিদারির খাজনা আদায়ের কাচারির একটি ধ্বংসাবশেষ, একটি বেশ বড় দ্বিতল ভবন। বর্তমানে এখানে নির্মিত হয়েছে একটি আধুনিক অডিটোরিয়াম। দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আঙ্গিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরী করা হয়েছে সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান। রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম শাহজদাপুর আসেন। রবীন্দ্রনাথ এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবন প্রবাহের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হন।

আমাদের জীবনে বড় বড় মানুষের সংখ্যা হাতে গোণা। বাঙালির মেধা ও মেধা ভিত্তিক জগতে যে কজন বড় মাপের মানুষ তাঁদের সবাইকে আমরা কোন না কোন ভাবে অপমান করেছি। অপমান করেই চলেছি। সে তিনি বিদ্যাসাগর হন বা কাজী নজরুল হন যেই হন না কেন তাঁদের অপমানেই আমাদের অনন্দ। বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশকে ঘোর অপমান করে অপদস্থ করে ট্রামের তলায় পড়তে দেখে আনন্দ পাওয়া জাতি কোন মান সম্মান ই নিজের মনে করে না । আজ এই কাচারি বাড়ির ওপর যে আক্রমন তার কারণ যাই হোক এটিও একটি কালো দাগ হয়ে থাকবে।

মাত্র কিছুদিন আগে বলা হয়েছিল এনাফ ইজ এনাফ। আমরা আর মব কালচার দেখবো না। মব আক্রমণ বা এ জাতীয় সহিংসতা সহ্য করা হবে না। কিন্তু এমন ঘটনা প্রমাণ করছে মব আছে। মব থাকবে। কারণ মব বা উত্তেজিত জনতা বা জনতার এক ভগ্নাংশের কোন বিচার হয় না। সুস্থ ও সুন্দর সমাজ থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশীরা এসব ঘটনায় আর হতবাক হন না। এই বিষয়টা আমাদের জন্য কতটা মারাত্মক সেটাও তারা আর ভাবেন না। ভাবেন না কারণ প্রকাশ্য জনপদে রাস্তায় নারীদের লাথি মারা লাঠি দিয়ে পেটানো জান হাতে নেয়া এখন রোজকার বিষয়।

কথা হচ্ছে এই কি কথা ছিল? যে রাজত্ব খতম করার জন্য মানুষ মাঠে নেমে এসেছিল তার সাথা আজকের বাস্তবতার ফারাক কোথায়? পুলিশ নিরাপত্তা বাহিনী বা কর্তাদের অসহায়ত্ব এখন সবার চোখের সামনে। বিশ্বাস ও আস্থার এমন বিপর্যয় মানুষ কিভাবে মানবে? যারা ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেছিলেন তারা নানা ভাবে তা প্রকাশ করতে পারতেন, সেটা না করে এমন ঐতিহাসিক বাড়ির লোকসান বা তার ভাঙ্গচুরের ভেতর ইন্ধন নাই বলা টা অনুচিত। ইন্ধন আছে। যে দেশের রাজধানী শহরে ৩২ নাম্বার ধানমন্ডীর ঐতিহাসিক বাযি বুলডোজারের তলায় চাপা পড়ে যে দেশে ইচ্ছেমত ভবন ধ্বংস বা বিনষ্ট করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া যায় সেখানে এমন হামলা স্বাভাবিক বলেই মনে হবে।

সংস্কার আর পরিবর্তনের কথা বলা মানুষগুলো চুপ থাকলে চলবে না। রবীন্দ্রনাথের এতে কিছু যায় আসে না। তাঁর সৃষ্টি বা মহত্ত্বতে বিন্দুমাত্র কিছু হারাবে না। হারছি আমরা। হেরে যাচ্ছে আমাদের সম্মান। আমাদের জাতিসত্তার গৌরব ও সম্মানের যে ভয়াবহ বিপর্যয় সেটাই এখন ভাবার বিষয়। আজ কাচারি বাড়ি কাল শিলাইদহ পরশু অন্য কিছু এমন পাশবিক অনাচার আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনের ওপর আঘাত। কোন সুস্থ বিবেকবান বাঙালি তা মানতে পারে না। জাতি যদি সবকিছুতে বোবার অভিনয় করে কিংবা চুপ থাকতে বাধ্য হয় তাহলে অপসংস্কৃতি আর অনাচার আমাদের গিলে খেতে দেরী করবে না।

রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বড় কবি এবং একজন দার্শনিক ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন, তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। এমন ঘটনায় প্রমাণিত হয় আমরা পতাকা পেলেও তা বহন করতে পারছি না। হঠাৎ করে এমন একটা ঘটনা আমাদের অন্তরে আঘাত করেছে। এর প্রতিবিধান জরুরি। আগেই বলেছি মব বা আক্রমণের সংস্কৃতি জাতিকে কোনঠাসা করতে করতে দেয়ালে নিয়ে ঠেকাচ্ছে। সহসা এর অবসান না হলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না। রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর যে কোন কিছুর ওপর আঘাত আগেও ভালো ফল বয়ে আনে নি। এবারেও আনবে না। এটা যত তাড়াতাড়ি বোঝা যাবে ততই মঙ্গল। লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসড়ক, মহাসড়কে তারের জঞ্জাল অপসারণ করা হোক
পরবর্তী নিবন্ধবাংলায় মসনবী শরীফ