স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যকার্ড : চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনন্য কার্যক্রম

অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী | বুধবার , ২১ মে, ২০২৫ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

ভূমিকা: ‘স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’ প্রদান কর্মসূচি চালু হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত পাঁচ স্কুলে। ২১ মে ২০২৫ বুধবার কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে এর আনুষ্ঠানিক শুভ সূচনাপর্ব। দেশে বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য এটা এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। কেননা ইতোপূর্বে আর কোনো বিদ্যায়তনে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের হিতকর এরকম স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা পায়নি।

মূলত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন এর সোৎসাহ সমর্থনে এই কর্মযজ্ঞের শুরু। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত ৫৫ টা স্কুলে পর্যায়ক্রমে এই কর্মসূচি পরিচালিত হবে। যা ৫০,০০০ এর অধিক স্কুলশিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেবে, যাতে তারা সুস্থসবল থেকে পড়াশোনায় রাখবে মেধার স্বাক্ষর।

স্কুল শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য কার্ড’ কী:‘স্টুডেন্টস হেলথ কার্ড’এ লিপিবদ্ধ আছে: শিক্ষার্থীর পরিচয় মূলকনাম, জন্মনিবন্ধনকৃত জন্মতারিখ, আইডি নম্বর, বিদ্যালয়ের নামই মেইল ঠিকানা, মাবাবার ঠিকানা, ও রক্তের গ্রুপ প্রভৃতি, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল ও চিকিৎসক নিদের্শনা, ইপিআই টিকা সহ হুবিপিএ প্রস্তাবিত টিকাকরণ রেকর্ড। পরবর্তীতে যা অনলাইনে সংযুক্ত হতে পারে।

এই কার্ড এনে দেবে ‘স্কুল স্বাস্থ্য নির্দেশিকা ’ মেনে সন্তানের স্কুলজীবনে পরিপূর্ণ ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্যসেবা’ প্রাপ্তির সেরা সুযোগ। যার প্রয়োগ বিদ্যালয়পড়ুয়াদের নিমোক্ত অভিষ্ট লক্ষ্য সাধনে সক্ষম। যেমন

. স্বাস্থ্যকর স্কুল পরিবেশ

বিদ্যালয়গামী শিশুরা সমাজের এক বৃহৎ (প্রায় ২৫%) অংশ। এই সময়টাতে শারীরিক বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সাথে মানসিক বিকাশ ঘটে বিদ্যার্থীর। এই বয়সের সামান্য বিপত্তি যেমনপরিবেশগত দূষণ, সুষম খাদ্যপুষ্টির অভাব, সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণজনিত ক্ষত পরবর্তী জীবনে সৃষ্টি করে দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া।

তাই বিদ্যালয়ে শিশুদের জন্য ‘স্বাস্থ্যকর স্কুল’ পরিবেশ, যেমনবিশুদ্ধ পানীয় জল, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যবিধি, নিরাপদ খেলার মাঠ, পরিচ্ছন্ন টিফিন রুম প্রভৃতির বন্দোবস্থ থাকা উচিত।

এক জায়গায় একসঙ্গে থাকার কারণে স্কুলশিশুদের ‘স্কুল হেলথ সার্ভিস’ আওতায় আনা সহজ। যেমননিয়মিত স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, অপুষ্টি মোকাবিলা, দৈহিকমানসিক অস্বাভাবিকতা আগেভাগে শনাক্তকরণ, এবং ফলোআপ কেয়ার।

বিদ্যালয়ে প্রতি পাঁচজনে একজন শিক্ষার্থী কোনো না কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় পতিত হয়। এক্ষেত্রে ‘স্কুল ক্লিনিক’ অধ্যয়নরত শিশুদের শারীরিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনে ল্যাবটেস্ট করিয়ে সময়মতো চিকিৎসা দিতে পারে, এভাবে যা অঙ্কুরে বিনাশ করে তাদের অনেক স্বাস্থ্যগত সমস্যা।

স্কুলের জীবনধারায় ছাত্রছাত্রীরা নতুন অনেক কিছু শেখে। যেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের মাধ্যমে তাদেরকে হাইজিন, খাওয়াদাওয়াঘুম প্রভৃতি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাপ্ত স্বাস্থ্য সম্পর্কিত এসব জ্ঞান পরবর্তীতে এরা ঘরে ও সমাজে প্রয়োগ করে। গড়ে দিতে পারে দেশব্যাপী স্বাস্থ্যকর পরিবেশ আন্দোলনের সিঁড়ি।

. স্কুল হেলথ টিম

বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রণয়নে প্রাথমিক কাজ হলো: প্রধান শিক্ষকের সাথে ২৩ জন শিক্ষক (কমপক্ষে ১ জন পুরুষ এবং ১ জন মহিলা, বিশেষত যাঁদের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের পটভূমি জীববিজ্ঞান / হাইজিন বিষয়ে পড়াশোনা আছে) ও সমন্বয়কারীহিসাবে কয়েকজন স্কুল শিক্ষার্থী, যাদের বেশিরভাগই সিনিয়র ক্লাসের, নিয়ে ‘স্কুল হেলথ টিম’ গঠন।

. শিক্ষার্থীর লগবুক

লগবুকের ‘চাইল্ড ভিজিট ক্যালেন্ডার’ স্থায়ী রেকর্ডনামা তৈরি করে। শিশুর পূর্বাপর অসুখ ও চিকিৎসার এসব স্বাস্থ্যবিবরণী দেশেবিদেশে চিকিৎসা গ্রহণে স্কুল, কলেজ, ইনসুরেন্স কিংবা চাকুরী জীবনেও ‘স্বাস্থ্যডায়েরি’ হিসেবে পেশ করা যায়।

. স্বাস্থ্য শিক্ষা

স্কুল ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকশিক্ষিকাদের অংশগ্রহণে বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষামূলক অধিবেশনের আয়োজন , শিক্ষার্থীদের পুষ্টি সচেতনতা তৈরি, সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ, আচরণজনিত সমস্যার শিকার শিশুর শিশুসাইকোলজি শিক্ষার প্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ।

. স্কুল ক্লিনিক

বিদ্যালয়ে শিশু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লে, বমি, ডায়রিয়া, খিঁচুনি বা দুর্ঘটনার শিকার হলে ‘প্রাথমিক চিকিৎসা’ দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ ও ওষুধের ব্যবস্থা ( ফার্স্টএইড বক্স) থাকলে বিপদ লাঘবের সুযোগ থাকে।

রেজিস্টার্ড মেডিকেল প্র্যাকটিশনার, বা সম্ভব হলে কোনো শিশুচিকিৎসককে স্কুলের ‘স্বাস্থ্য কর্মকর্তা’ পদে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। সময়ে সময়ে তাঁকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ট্রেনিং কোর্সে সংযুক্ত করানো।

খন্ডকালিন নিয়োগের আওতায় অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিকিৎসক যেমননাককানগলা, চক্ষু বিশেষজ্ঞ, স্পিচথেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট এর সহযোগিতা নেওয়া।

. স্কুল নার্স

অনেক স্কুলে নিয়মিতভাবে সিনিয়র অভিজ্ঞ স্কুলনার্স ও স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্টটাইম বেসিসে।

স্কুল নার্সের দায়িত্ব সমূহ: স্কুলের স্টাফ থেকে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিষয়াদি জেনে নেওয়া ও তাদের ফলোআপ করা। শিশুর পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার, ত্বক, হাতপা, চুল, দাঁত, মুখ প্রভৃতি যত্ন নেওয়া বিষয়ে পরামর্শ দান।

শিশুর উচ্চতা এবং ওজন নির্ণয় করে শিশুর বৃদ্ধিবিকাশ চার্টে লিপিবদ্ধ করা, তিনি স্কুলহাইজিন ও পরিবেশ নিয়মিত তদারকি করে ডেঙ্গু মহামারির মতো রোগবিস্তার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারেন।

. দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির পরীক্ষা

শিশুর পড়ালেখার সমস্যা দেখা দেওয়ার প্রধান দুই কারণ:চোখে দেখার সমস্যা ও কানে শোনার সমস্যা। যা স্কুলবয়সে প্রাথমিক স্তরে নির্ণয় হওয়া উচিত। সাধারণভাবে স্কুল নার্স দ্বারা এসব পরীক্ষা করিয়ে ও প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার।

. সংক্রমণ প্রতিরোধ

বিভিন্ন সংক্রামক অসুখ ছড়িয়ে যাওয়ার এক সহজ জায়গা হলো স্কুল। কোনো শিশু সংক্রামক রোগ নিয়ে স্কুলে এলে, তাকে ক্লিনিক্যাল উন্নতি না হওয়া ও স্যাম্পল পরীক্ষায় জীবাণুর অনুপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত স্কুলে আসা নিবৃত্তকরণ। শিশু যক্ষ্মাক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান। ছাত্রছাত্রীরা যেসব সংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে আছে, তাদের জন্য প্রতিষেধক টিকাদানের ব্যবস্থা ।

. স্বাস্থ্য ক্যাম্পের আয়োজন

সম্ভব হলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগ, দন্ত, চক্ষু, নাককানগলা প্রভৃতি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়ে ‘স্বাস্থ্যক্যাম্পে’র আয়োজন।

১০. সুষম পুষ্টির টিফিন

যেসব এলাকায় দাঁতের ক্ষয় রোগ, আয়রন ঘাটতিজনিত রক্তস্বল্পতা, রাতকানা, আয়োডিনের অভাবজনিত গলগন্ডসহ নানাবিধ অপুষ্টি সমস্যা বিদ্যমান আছে, সেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের খাদ্যপ্রাণ ও খনিজ ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা।

এবং শিশুর প্রয়োজনীয় দৈনিক প্রোটিনের অর্ধেক ও দৈনিক ক্যালরির একতৃতীয়াংশ ‘ না লাভনা ক্ষতি’ এরকম পদ্ধতিতে ‘স্কুল মিল’ চালুকরণ।

১১. দরকার স্কুল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা

বিদ্যালয়ে নিরাপদ প্রাচীর, পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলোবায়ু পূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ, ছেলে ও মেয়েদের আলাদা ইউরিনালশৌচাগার, নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সহ প্রতিটা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্কুল হেলথ টিম গঠন পূর্বক নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপরিউল্লেখিত স্বাস্থ্য সেবা সচল করতে পারে।

উপসংহার:

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ( হু) সুপারিশ মতে বিদ্যালয় পড়ুয়াদের স্বাস্থ্যকর আচরণে উদ্বুদ্ধকরণ, দৈহিক, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি, স্কুল রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা সম্পৃক্ত ‘বিদ্যালয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ একান্ত জরুরি।

স্কুলশিক্ষার মতো ‘স্কুলস্বাস্থ্য’ শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার। ‘নীরোগ দেহ নির্মল মন’ এর সুস্থ শিশুই সেরা শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা পরিকাঠামো অত্যন্ত বিস্তৃত ও শক্তিশালী। অনেক বছর ধরে শিশুস্বাস্থ্যবিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি ও কর্মপ্রচেষ্টায় এরকম সমন্বিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চেয়েছিলাম। যা সাধিত হলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে চিকিৎসক মেয়রের হাত ধরে।

এ সময়ে দেশে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখের অধিক শিক্ষার্থী প্রাথমিকমাধ্যমিক মিলিয়ে অধ্যয়নরত। কায়মনোবাক্যে চাইদেশের প্রতিটা বিদ্যানিকেতন নিজ শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যয়সাশ্রয়ী অণুপ্রেরণাদায়ক এরূপ প্রকল্প গ্রহণ করুক।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ,

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাক-ভারত যুদ্ধে চীনের পোয়াবারো এবং সাম্প্রতিক নানা বিতর্ক
পরবর্তী নিবন্ধবৈশাখের ছড়া