সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হবে রেলের হাসপাতালগুলো

পরিচালনা ও সেবার মান বাড়াতে ৪ নির্দেশনা পাহাড়তলী কারখানায় ট্রেনের ইঞ্জিন ও কোচ সংযোজন করা হবে চবি ও চুয়েটের জন্য নতুন কমিউটার ট্রেনচালুর পরিকল্পনা চট্রগ্রামে উপদেষ্ঠা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, রেলওয়ের হাসপাতালগুলো এবার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। স্থানীয় সিভিল সার্জনদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ কমিটি এই হাসপাতালগুলো পরিচালনা করবে। এসব হাসপাতালে এখন থেকে রেলকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেলওয়ে সমঝোতা চুক্তি করে চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় জনবল ও ওষুধযন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হবে। গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান স্থাপনাগুলো পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা প্রথমে সকাল ৮টায় পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপ পরিদর্শনে যান। এসময় তিনি এসব স্থাপনার পরিবেশ ও মান বাড়াতে কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। পাহাড়তলী রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন মেরামত কারখানা পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, এই ওয়ার্কশপে অনেক সংকট। এখানে জনবলেও সংকট রয়েছে। এই ওয়ার্কশপ রেলওয়ের স্ট্যান্ডার্ড না। বর্তমানে এই ওয়ার্কশপে রিপেয়ার ও মেনটেইনেন্স করা হয়। আমরা এটাকে আরও উপরে নিয়ে যেতে চাই। ‘আমরা এগুলোকে রিপেয়ার, মেনটেইনেন্স এবং অ্যাসেম্বেলিং ওয়ার্কশপে রূপান্তর করতে চাই। যাতে লোকোমোটিভের পার্টস এনে এখানে অ্যাসেম্বেল করা যায়। যার ফলে আমাদের খরচ কমবে এবং নতুন কর্মসংস্থান হবে। সেজন্য ডিপিপি প্রস্তুত করার জন্য বলা হয়েছে। সেটা হলে পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে কথা হয়েছে দ্রুতই হয়ে যাবে।’ সরকার রেলের বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে আধুনিক পরিষেবা দিতে কাজ উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে ইঞ্জিন ও কোচের যন্ত্রাংশ এনে দেশেই সংযোজন করা সম্ভব হবে, যা সময় ও অর্থ সাশ্রয় করবে। বর্তমানে সম্পূর্ণ ইঞ্জিন ও কোচ তৈরি করে আনতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ।

রেলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মিউজিয়াম সংস্কারের নির্দেশ : রেলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মিউজিয়াম সংস্কারের বিষয়ে রেলপথ উপদেষ্টা বলেন, ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হবে। ঐতিহ্য নষ্ট করে রিপেয়ার বা সংস্কারের নামে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে টাইলস দিয়ে চকচকে করে দিলে হবে না। কাঠের স্থাপনা কাঠ দিয়েই রিপেয়ার করতে হবে। যেটা যেমন আছে সেটা সেভাবেই রিপেয়ার করে সংরক্ষণ করতে হবে।

পাহাড়তলী কারখানা পরির্দশনের পর উপদেষ্টা সকালে সিআরবিতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। এসময় উপদেষ্টা হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও স্থাপনা ঘুরে দেখেন। এই সময় কর্মকর্তারা রোগী ভর্তি না হওয়া ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ হাসপাতাল পরিচালনায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে। আবার রোগী ভর্তি হলেও কিছু বিধির কারণে সব রোগীকে খাবার সরবরাহ করা যায় না।

রেলওয়ে হাসপাতালে বেডের অভাব নেই; রোগীর অভাব : সিআরবি হাসপাতাল পরির্দশনকালে হাসপাতালে কোনো রোগী দেখতে না পেয়ে উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালটি ঘুরে দেখলাম। এই ধরনের হাসপাতাল দেশের আরও বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপে শয্যা খালি থাকে না। কিন্তু এই হাসপাতালে (সিআরবি হাসপাতালে) দেখি বেডের অভাব নেই; রোগীর অভাব! এ সময় তিনি হাসপাতাল পরিচালনা ও সেবার মান বাড়াতে চারটি নির্দেশনা দেন। এগুলো হচ্ছেহাসপাতাল পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠন করতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসক এই হাসপাতালে সংযুক্তি দিতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও খাবার সরবরাহ করবে। এই হাসপাতাল রেলকর্মীদের পাশাপাশি সর্ব সাধারণের চিকিৎসা সেবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে। আমার সাথে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কথা হয়েছে। এই ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় সমঝোতা স্মারক চুক্তি করবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা চিকিৎসকদের সংযুক্তির মাধ্যমে পদায়ন করে রেলওয়ের হাসপাতাল অবকাঠামোকে বৃহত্তর পরিসরে ব্যবহার করবে সরকার। এ সময় হাসপাতালে সংকট নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলামকে নির্দেশ দেন উপদেষ্টা।

এসময় রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, এখন বিভিন্ন বিভাগ বা দপ্তরে আলাদা আলাদা করে কাজ করা যাবে না। সবাই সরকারের হয়ে কাজ করবেন, জনগণের জন্য কাজ করবেন। আর নতুন ধরনের কোনো স্থাপনা এই মুহূর্তে করা হবে না বলে জানান তিনি।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীতে অবস্থিত রেলওয়ে ক্যারেজ অ্যান্ড ওয়াগন মেরামত কারখানা, ডিজেল ওয়ার্কশপ কারখানা, রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, ইউরোপিয়ান ক্লাব ও রেলওয়ে জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ নয় বলে মন্তব্য করে রেলপথ উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হবে। শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হবে।

রেলওয়ের স্থাপনা ও হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে দুপুরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির। এরপর জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের অগ্রগতি নিয়ে সন্ধ্যায় সিআরবির কনফারেন্স রুমে নগরীর সেবা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। এরপর স্থানীয় সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ব্রিফিং করেন উপদেষ্টা।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, রেলওয়ের অধীনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, পাকশী, লালমনিরহাট ও সৈয়দপুরে হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ৪টি ও পশ্চিমাঞ্চল রেলের হাসপাতাল রয়েছে ৬টি। এসব হাসপাতালে ২৭০টি শয্যা থাকলেও অধিকাংশ সময় তা রোগীশূন্য থাকে।

এসময় উপদেষ্টার সাথে উপস্থিত ছিলেন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. সবুক্তগীণ, পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবু জাফর মিঞাসহ ঊর্ধ্বতন সকল কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

নতুন ২৫০টি কোচ যুক্ত হবে রেলবহরে : এদিকে সন্ধ্যায় সিআরবির কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, সামনে আরও ২৫০ নতুন কোচ আসবে। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের যাতায়াতে সুবিধা দিতে নতুন কমিউটার ট্রেন চালুর পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তিনি বলেন, নতুন করে ২৫০টি কোচ রেলবহরে যুক্ত হবে। এর একটি অংশ দিয়ে চবি ও চুয়েটের জন্য কমিউটার ট্রেন চালু করা হবে। শিক্ষার্থীদের সময়মতো এবং নিরাপদে ক্যাম্পাসে যাতায়াত নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।

তিনি আরও জানান, সিলেট রুটেও নতুন ট্রেন সংযুক্তির পরিকল্পনা রয়েছে। সিলেট অঞ্চল দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। যাত্রীর চাপ বিবেচনায় সেখানে নতুন ট্রেন চালু করা হবে। এতে স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকরাও উপকৃত হবেন। নতুন ইঞ্জিনও আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বর্তমানে রেলে এক টাকা আয় করতে খরচ হয় আড়াই টাকা : রেল খাতে ব্যয়ের চেয়ে আয় কমএই সমস্যা প্রসঙ্গে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, বর্তমানে রেলে এক টাকা আয় করতে খরচ হচ্ছে প্রায় আড়াই টাকা। এই ‘অপারেটিং রেশিও’ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য এটি দুই টাকার নিচে নামিয়ে আনা।

রেল খাতে পাঁচটি বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা : উপদেষ্টা বলেন, রেল খাতে পাঁচটি বড় ধরনের সংস্কার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পুরোনো রেলপথ সংস্কার, নতুন রুটে সংযোগ, আধুনিক যাত্রীসেবা চালু, ডিজিটাল টিকিটিং ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা জোরদারকরণ। রেলকে লাভজনক ও টেকসই খাতে রূপান্তরের জন্য সকল পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

রেল প্রশাসনকে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছেসাংবাদিকদের তথ্য পেতে যেন সহায়তা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, রেল শুধু যাত্রী নয়, পণ্য পরিবহনেও বড় ভূমিকা রাখতে পারে। বন্দরের সঙ্গে রেল সংযোগ আরও মজবুত করা গেলে দেশের অর্থনীতির গতি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, আমরা চাই জনগণ রেলকে নিজের বাহন মনে করুক। নিরাপদ, স্বস্তিদায়ক এবং সময়মতো যাতায়াত নিশ্চিত করাই আমাদের অঙ্গীকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৬ মাসের মধ্যে পাচার হওয়া সম্পদ শনাক্ত করা হবে
পরবর্তী নিবন্ধপাহাড়ে বৈসুর সুর