সভ্যসমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠনের সকল কর্মকৌশল অবশ্যই প্রতিপালনযোগ্য। প্রাগ্রসর সমাজের দৃষ্টান্ত হিসেবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেকোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দেশের আপামর জনসাধারণের আশা আকাঙ্ক্ষাকার প্রতিফলন ঘটিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের অবারিত সাফল্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথার্থ ধারণ ও পরিচর্যা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে উন্নয়ন–অগ্রগতির অন্যতম উপাদান। সমগ্র জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক চিন্তা–চেতনার উপস্থাপনে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অবাধ–সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাবলীল অনুষঙ্গ। নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটার কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতায়নে জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। সকল দল–মতের সম্মিলিত অংশগ্রহণ–সমর্থনে নেতৃত্ব বাছাই এবং সঠিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
পবিত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সকলেই অবগত যে, আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) গণতন্ত্রের সর্বজয়ী প্রবক্তা হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদাসীন। নবী করিম (স.) সকল সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করেই যেকোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তিনি কখনো একা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া বা চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন না। এমনকি যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তাঁর একই ধরনের আচরণ ইতিহাস সমৃদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে সকলের মতামতে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের মৌলিক অনুষঙ্গ। যদিও আধুনিক গণতন্ত্রের ব্যাখায় আব্রাহাম লিংকনের বক্তব্যকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়, তা কতটুকু যৌক্তিক তার বিশ্লেষণও প্রয়োজন। তবুও গণতন্ত্র হলো আধুনিক বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমাদৃত শাসনব্যবস্থা যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্রই সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। বিপুল পরিবর্তন–পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানেও গণতন্ত্র সমধিক জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। গণতন্ত্র যেকোন সমাজে পরিশুদ্ধ পন্থায় সকল নাগরিকবৃন্দের কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে।
যুক্তি–জ্ঞাননির্ভর সমাজের বিজ্ঞানমনস্ক গুণগত বিকাশমানতার প্রসার পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার অনবদ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এরই অনুকরণে অনুন্নয়–উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়ন প্রবাহের গতিপ্রকৃতি নির্মিত হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি সমাজে ক্রম বিকাশের ধারায় প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০০ বৎসর পূর্বে হেরোডেটাস কর্তৃক প্রণীত গণতন্ত্রের ধারণাকে এখনও স্বাভাবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামোর অতি নিকটতর মনে করা হয়। আদিম মানবগোষ্ঠীর সহজ–সরল শাসন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধরে রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্র নামক অস্বাভাবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিপরীতে জনগণ জীবন ব্যবস্থা রূপে গণতন্ত্রকে বেছে নেবে– এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সমাজ ও রাষ্ট্র দিয়ে গেছে।
গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধ হচ্ছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অর্থাৎ ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতার তথা চিন্তা–স্বাধীনতা, বাক–স্বাধীনতা, সংগঠনের স্বাধীনতা, ভোট দান, দলগঠন এবং অংশগ্রহণ, প্রার্থী হওয়ার স্বাধীনতা, নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা, ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা ও অভিযোগ স্থাপনের স্বাধীনতা অর্থাৎ সার্বিকভাবে জীবনধারণের অধিকার, পরিবার গঠনের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, আইনের আশ্রয় অধিকার, স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার, বিরোধিতার অধিকার ইত্যাদি সকল কিছুকেই অন্তর্ভূক্ত করে। গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিত্ব বিকাশের সাথে অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা, সহনশীলতা, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতকে সাদরে গ্রহণ করার মানসিকতা। যে কোন সামাজিক প্রক্রিয়াই ব্যক্তির স্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব ও সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ একমাত্র সম্পদ গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করে। এজন্যই বিশ্বের সকল সভ্য দেশ, বিবেকবান, মানবতাবাদী মানুষ, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ও প্রত্যাশী। গণতান্ত্রিক শিক্ষাই হচ্ছে নিজের ইচ্ছার সাথে অন্যের ইচ্ছার সমন্বয় ঘটানো বা অধিকাংশের ইচ্ছা বা আগ্রহকে যৌক্তিকভাবে নিজের বা ব্যক্তির অধিকারে সন্নিবেশন।
গণতন্ত্রের ঐতিহ্যিক সৌকর্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠান। আধুনিক সমাজের চলমান অবস্থানে যেকোন জাতিরাষ্ট্রে অবাধ–সুষ্ঠু–নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার পালাবদল হয়ে থাকে। জনগণের বিকশিত সত্ত্বায় স্বমহিমায় যুক্তি–মুক্তচিন্তা নির্ভর ভাল–মন্দ, ন্যায়–অন্যায়, ব্যক্তি ও জাতির উন্নয়ন–অনুন্নয়ন সাধারণ মানুষের বোধগম্যতে প্রোথিত। স্বল্পশিক্ষিত–শিক্ষিত বা সচেতন জনগণ মাত্রই নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার অধিকার প্রয়োগের প্রচেষ্টা অতিসুস্পষ্ট। এইক্ষেত্রে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রায়োগিক বাস্তবায়নে ব্যত্যয়ের বিষয়ে আধুনিক যেকোন নাগরিক অত্যন্ত সচেতন। শহর–নগর–জনপদসহ প্রান্তিক পর্যায়েও বিভিন্ন দলের বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য–আদর্শ এবং নেতা–নেত্রীর যোগ্যতার মাপকাঠিতে জনপ্রতিনিধি নির্ধারণে মানুষের ধীশক্তি প্রচন্ড প্রবল। অতীতের মত অর্থবিত্ত বা নানামুখী চাপ প্রয়োগে ভোট নেওয়া এখন কষ্টসাধ্য ব্যাপার। প্রকৃষ্ট পন্থায় নিজের বিবেকের প্রসারমানতায় ভোটাধিকার প্রয়োগের মাত্রিকতা অনেক বেশি উৎকর্ষ। কথায় বা কাজের মিল খোঁজে এবং অতীতের আচরণকে যাচাইবাছাই করে নির্বাচনে প্রার্থীর চরিত্র উদ্ঘাটন অনেক সহজসাধ্য ব্যাপার।
দমন–পীড়ন–নিপীড়ন–নির্যাতন–গুম–খুন হত্যাকারীদের পরিচয় সমগ্র সমাজেই বিস্তৃত। অবৈধ–অনৈতিক পন্থায় অর্থ উপার্জন, ঘুষ–দুর্নীতির ধারক ও বাহক, চাঁদা–দখলবাজী, লম্পট মাদকসেবীর মত দুশ্চরিত্রের লোকগুলো সমাজে এখন অনাহুত। এমনকি অশিক্ষিত–কমশিক্ষিত ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অন্য কারো মুখপেক্ষী থাকে না। প্রায় প্রত্যেক পরিবারেই অতীতের মত মহিলাদের প্রভাবিত করে নিজের মতামত চাপিয়ে দিয়ে ভোট আদায়ের প্রক্রিয়া পরিত্যাজ্য। একই পরিবারে স্বামী–স্ত্রীসহ সন্তান–সন্ততির মধ্যেও সামাজিক–রাজনৈতিক মতপার্থক্য পরিলক্ষিত। মজার বিষয় হচ্ছে, নানা বিষয়ে তর্ক বিতর্কে দলের সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ–বিদ্বেষ–প্রতিশোধ–প্রতিহিংসাপরয়নতা প্রায় স্তিমিত। স্ব স্ব ধারণা নির্ভর আদর্শিক চেতনা উজ্জ্বীবিত থাকলেও পরিরারের বন্ধনকে অটুট রাখার ক্ষেত্রে সকল সদস্যই ঐক্যবদ্ধ থাকে। এটিই বাংলাদেশ–সমাজের নতুন বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিগণিত।
এটি অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবাধ–সুষ্ঠু এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক যৌক্তিক ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রণিধানযোগ্য ঐতিহ্য। নির্বাচন কমিশন যথার্থ দক্ষতা–যোগ্যতা–নিরপেক্ষতার সক্ষমতায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে এটিই কাম্য। কমিশনের শক্তিমানতাই নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্যতম নিয়ামক। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই যথাযথ আইনি এখতিয়ারে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধি নির্বাচন–সরকার গঠন একটি প্রচলিত পরিক্রমা। জনগণের সমর্থনের উপর পূর্ণাঙ্গ আস্থার ভিত্তিতে ঘোষিত রায়ে ফলাফল গ্রহণ এবং তদানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি সত্ত্বেও যেকোন সময় সহিংসতা–নাশকতা ঘটার সন্দেহে জনমনে ভীতি সঞ্চারণ অমূলক নয়। উজ্জীবিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে দলীয় নেতাদের উত্তেজক বক্তৃতা–বিবৃতিতে নানা ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সকল প্রকার হুমকি–ধমকি এবং সংযত আচরণ বহির্ভূত অন্য কোন বিরোধ–বিচ্ছেদ পন্থা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। বিরাজিত দেশীয় এবং বৈশ্বিক পর্যুদস্ত অর্থনৈতিক সংকটে যেকোনো দলের অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা জনগণ সহজেই অনুধাবন করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সব পক্ষকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেছে। জনকল্যাণে সকল ধরনের অসংযত আচার–আচরণ, জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, দখল–চাঁদাবাজি সংহার করে নেতৃবৃন্দ দলকে সুসংহত করার সতর্কবার্তা দিয়েছেন। জনগণ অধির আগ্রহে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার প্রতীক্ষায় রয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রীক সকল বিরূপ ধারণাকে অবজ্ঞা করে নিরাপদ–অহিংস পরিস্থিতি তৈরি একান্তই বাঞ্ছনীয়। জয়–পরাজয়ের সমীকরণে জনগণের রায়কে সমধিক গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করাই হবে প্রার্থীদের পবিত্র দায়িত্ব। উদ্ভূত যেকোন সমস্যা সমাধানে সহিংসতামূলক কার্যক্রম পরিহার করে পর্যাপ্ত যৌক্তিক আলাপ আলোচনা ও সম্প্রীতি–সৌহার্দের পারস্পরিক সমঝোতাই হয়ে উঠুক অন্যতম নির্বাচনী ব্রত। ধর্ম–বর্ণ–দল–মত–অঞ্চল নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক নিজের অবস্থান থেকে যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপনই প্রত্যাশিত। মোদ্দাকথা দেশ ও বিশ্ববাসীর কাছে নিরপেক্ষ নির্বাচন বলতে সাধারণত যা বুঝায়; বৈশিষ্ট্য সমূহকে যথার্থ তাৎপর্যতায় উদ্ভাসিত করে নির্বাচন কমিশন অবাধ–সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাদের প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠা করার যেকোন উদ্যোগ গ্রহণে ন্যূনতম পিছপা হবেন না– এটুকুই সাধারণ জনগণের কাঙ্ক্ষিত দাবি।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী