হেলাল হাফিজ : দুঃখের আরেক নাম

শ্রদ্ধাঞ্জলী

কুমুদিনী কলি | বুধবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:০০ পূর্বাহ্ণ

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,

কতো হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার।’

প্রথম পঙক্তিতেই আমরা মুগ্ধ হই। আমরা ভেবে দেখি, হ্যাঁ এটাতো আমারও মনের সুপ্ত ইচ্ছে। আমিও এমনই কাঙালপনা করি আমার প্রিয় মানুষটির সাথে, করতে চাই। তবে পার্থক্য এই, আমরা প্রকাশ করিনা।

আমরা প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত।

অথবা,

কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে

আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা’

অথবা,

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’

শুধু প্রেমের হাহাকার তুলে ধরা কবিই তিনি নন, তুলে ধরেছেন দেশ কালের সামগ্রিক চিত্র। আমাদের মনের চরম নিখাদ সত্যিটুকুর প্রখর উচ্চারণে তিনি হয়েছেন সবার পরিচিত কবি, কবি হেলাল হাফিজ।

কবিতা, প্রেম, আলস্য, অভিযোগ, অভিমান, নিভৃতবাসে জীবনের অপচয়, বিরহে বুঁদ হয়ে থেকে সন্ন্যাসব্রত। এসবের মিলিত রূপ কবি হেলাল হাফিজ।

একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ তাঁকে নিয়ে গেছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

হয়েছেন দেশের জীবন্ত কিংবদন্তী। পরপর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থও বিপুল খ্যাতি লাভ করেছে, তবে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ অন্যতম। অথচ তাতেও কী সাধারণ, কী নিভৃতচারী একজন। জীবন জুড়েই তাঁর বিরহগাথা। নিঃসঙ্গতার সাথেই সংসার তাঁর। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেও এমন সাধারণ পরিমিত জীবনচরণ, এমন একাকী, এমন বোধ, এমন সাহসী উচ্চারণ বলেই তিনি হেলাল হাফিজ।

রবীন্দ্রনাথনজরুল বা পঞ্চপাণ্ডব পরবর্তী কবিদের পর বাংলা কবিতায় হেলাল হাফিজের উত্থান উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বমহিমায়। খুব বেশি লিখেছেন তা নয়, তবে তার বিষয়বস্তুর নির্বাচন, আবেগ, বিরহ, জীবনের নিত্যদিনের হাসিকান্না, সুখের ক্ষীণ হাসি, দুঃখের বিস্তীর্ণ পথ তাঁর কবিতাগুলোকে তরুণ প্রজন্ম তথা আপামর বাঙালিকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেছে তাঁর দিকে, সেখানে বাঙালি আধুনিক জীবনের হাসি কান্নার খোঁজ পেলো। সেখানে বাস্তবমুখী প্রেম বিচ্ছেদের ডালি নিয়ে উপস্থিত হলো ব্যস্ত জীবন। যেখানে বসে থাকা যায় না, বিরহে বুঁদ থেকেও সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়।

সেই নগরজীবনের প্রেম, প্রেম পরবর্তী বিচ্ছেদ, হাহাকারে তিনি জর্জরিত হয়েছেন, আর তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন সত্তা টিকিয়ে রাখার বাস্তবতায় আমরা কতোটা অসহায়। এই নিদারুণ বাস্তবতাবোধের মিশেলে তিনি অনন্য। প্রেমকে তিনি ধারণ করেছেন মননে, তাঁর কাছে প্রেম এক অন্য মাত্রায় ধরা দিয়েছে। আর দশজনের মতো প্রেমকে অনিবার্যভাবে পরিণতি দান করতে না পারায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন ঠিকই, তবে তাতে নান্দনিকতার মিশেলে তিনি তৈরী করেছেন একের পর এক বিরহব্যথায় সিক্ত কবিতা। সংসার তিনি ত্যাগ করেছিলেন, তাঁর সহ্য শক্তি অশেষ। তাঁর ধৈর্য ও সংযমে তিনি সন্ন্যাসজীবন পার করে দিলেন একজনমে। কবি তাঁর প্রিয়তমাকে লালন করেছেন হৃদয়ের মণিকোটায়। তাঁকে স্মরণে রেখেছেন তাঁর কবতায় এভাবে

কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে

কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বানে

পত্র দিয়ো, পত্র দিয়ো।’ (পত্র দিও)

তিনি জানতেন পত্র কখনো পাওয়া যাবে না তাই বিরহ বেদনায় নিজেকে এতোটাই প্রবোধ দিয়েছেন লিখেছেন

আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেয়ো, আপত্তি নেই।

গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কী তাতে?

…..

এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে,

এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে।’

তিনি অভিযোগটিও জানিয়েছেন তাঁর কবিতায় তাঁর প্রিয় মানুষটিকে। একটা জীবন পার করে দিলেন অভিমানেই।

তাঁর অগ্রজ কবিদের কাব্যগুণের সাথে যদি তুলনা করা হয়, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, হেলাল হাফিজ বাংলা সাহিত্যে নতুন এক বলয় তৈরী করেছেন। সময়ের অতি আধুনিকতা তাঁর মূল বিষয়বস্তু। তবে তাঁর কবিতার প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তিনি সহজ সরলভাবে যাপিত জীবনের যান্ত্রিকতার সাথে ভালোবাসা, প্রেম, রোমাঞ্চ, বিচ্ছেদ, আন্দোলন, সংগ্রাম সবকিছুকে একসূত্রে গাঁথতে পেরেছিলেন। এতেই সমসাময়িক তরুণদের কাছে হেলাল হাফিজ এক অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে। তাঁর কবিতাগুলো আবৃত্তির ক্ষেত্রেও একটা বিশেষ মাইলফলক হয়ে গেছে।

তিনি বলেছেন, ‘মানুষের নির্মমতায় আহত হয়ে একদিন কবিতার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই থেকে কবিতার সাথে আমার দারুণ সখ্য আর গেরস্থালি শুরু। তারপর মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে। এখন কবিতাই আমার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং প্রণয়ের একমাত্র মাধ্যম। আজকাল আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না। কি জানি, হয়তো সেও এতদিনে আমার ভেতরে খুব নিরাপদ আশ্রয় গড়েছে।’

কবি হেলাল সবসময় বলতেন, আমার জীবনে যারা আমায় ভালোবেসেছেন, তাদের সবার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। আর যারা আমাকে ভালোবাসেন নি, তাদের প্রতি আরো বেশি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাদের অবহেলা, অনাদর, প্রত্যাখ্যান আর ঘৃণাই আমাকে কবি বানিয়েছে।

এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

এই দুটো লাইনই কবি হেলাল হাফিজকে চিনিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। এমন আরো অনেক স্লোগানধর্মী কবিতার জন্ম দিয়ে তিনি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন পাঠকমহলে। স্লোগানে, দেয়াললিখনে, বক্তৃতায়, বাখোয়াজিতে এবং জনপরিসরে আরও যা যা উপায়ে যৌবন ও সাহসের যুগলবন্দী করা সম্ভব সব আলাপে হেলাল হাফিজ অনন্য, অসাধারণ! বিভিন্নজন, বিভিন্নভাবে তাঁকে বিশ্লেষণ করেছেন। জনৈক সাহিত্য সমালোচক তাঁকে, তাঁর চালচলনের ধরনকে তুলে ধরেছেন এভাবে

হেলাল হাফিজের অতটা পাবলিক পারসোনা ছিলো না। তিনি নানা সমাবেশে কবিতা পড়েছেন। বইমেলায় কিংবা সাহিত্যের অনুষ্ঠানে ঝোলা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরেছেন, অটোগ্রাফ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর উপস্থিতির চেয়ে বেশি উচ্চকিত ছিলো তাঁর অনুপস্থিতি। তাঁর কবিতা সবাই পড়ছে, কিন্তু তিনি সর্বত্র নেই। তিনি ছিলেন তাঁর নির্জনতার চিলেকৌঠায়।’

হেলাল হাফিজ জীবনের নানা দিক তুলে নিয়ে এসেছেন তাঁর সাহিত্যে। তাঁর কবিতায় সব ছিলো। দ্রোহ, যৌবন, মিছিল, অন্ত্যমিল, সাহস, প্রেম, বিরহ সব। এতটা না পাওয়া বিরহে তিনি ভারাক্রান্ত ছিলেন, কিন্তু তাঁর কলম থামেনি। এই কলম তাঁকে নিয়ে গেছে মিছিলে, স্লোগানে, হতাশা, বেদনার অন্তরদহনে। কিন্তু বাইরেরটা একদম পরিপাটি। কী অপূর্ব সংযম, ধৈর্য। দুঃখের তিমিরে ডুবে থাকার মানুষ তিনি নন। অতটা তাঁকে পোষায়ও না। বরং তিনি তাঁর বেদনাকে বলেন, কেঁদো না।

লেখক: প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ