‘দেবতাকুম’ বান্দরবানের এক ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চকর পর্যটন কেন্দ্রের নাম। এখানে সুনসান নীরবতা, পাখির কলরব, সান বাঁধানো পাথরের সুউচ্চ পাহাড়ের মাঝখানে স্বচ্ছ জলধারা, খালের পানির স্রোতে পাথরে তৈরি হওয়া বিভিন্ন ধরনের নকশা আর খাঁজ দেবতাকুমের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে আরও কয়েকগুণ। এর পথে পথে রয়েছে রহস্যের সব হাতছানি। দীর্ঘ এক বছরের অধিক সময় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা শেষে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য খুলে দেয়া হচ্ছে এই পর্যটন স্পট।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বান্দরবান জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের শিখরে রয়েছে রোয়াংছড়ি উপজেলার দেবতাকুম পর্যটন স্পট। এটি মূলত তারাছা খালের একটি অংশ। দুপাশ সবুজ বাঁশ গাছের পাহাড়ে ঘেরা এবং গভীর জলের পাথুরে এলাকা। সহজে ঘুরে আসা যায় বলেই জেলার অমিয়খুম, নাফাখুম, সাতভাইখুম (জলাধার) এর মধ্যে দেবতাকুম পর্যটন স্পট সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
দুপাশের সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়ের কারণে দেবতাকুমের ভিতরে সরাসরি সূর্যের আলো পৌঁছায় না, তাই এর ভিতরে যতই যাওয়া হয় শীতল অনুভূত হয়। ঝর্নার পানির শব্দ শান্ত কোলাহল মুক্ত দেবতাকুমের ভিতরে বাঁশের ভেলা বা ছোট্ট নৌকা প্রবেশের মুহূর্তটি দারুণ ভয়ঙ্কর আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি হয় ভ্রমণকারীদের। তবে স্থানীয় দর্শণার্থীরা ভ্রমণ করতে পারলেও দীর্ঘ এক বছরের অধিক সময় ধরে নিরাপত্তা বিবেচনায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় দেবতাকুমের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছিল না পর্যটকরা। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ১১ ফেব্রুয়ারি জনপ্রিয় পর্যটন স্পট দেবতাকুম খুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
দেবতাকুমের নৌকা চালক অংসিং মারমা বলেন, দেবতাকুম সমিতির তত্ত্বাবধানে ভ্রমণকারী পর্যটকদের নৌকা ও বাঁশের ভেলা চালিয়ে দেবতাকুম ঘুরিয়ে দেখান। মাস শেষে ৫ হাজার টাকার মত খরচ পান। ভ্রমণকারী পর্যটকরাও খুশি হয়ে বখশিশ করতেন। এটা তার বাড়তি আয়। ফলে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। দীর্ঘদিন যাবৎ স্থানীয় প্রশাসনের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় পর্যটক না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দেবতাকুম খুলে দিলে বাড়তি উপার্জনে পরিবারে আবার স্বচ্ছলতা ফিরবে, সেই আশায় আছি।
দেবতাকুম স্থানীয় ব্যবসায়ী রবি জয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, দেবতাকুম পর্যটন স্পট ঘিরে পাড়ার শতাধিক বাসিন্দারের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পাড়ার লোকজন সমিতির তত্বাবধানে পর্যটকদের নিরাপত্তা, গাইড সেবা, লাইফ জ্যাকেট সেবা, খাবারের ব্যবস্থা করাসহ সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাড়তি উপার্জন করত। কিন্তু গতবছরের এপ্রিল থেকে নিরাপত্তা বিবেচনায় দেবতাকুম পর্যটন স্পট বন্ধ থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন স্থানীয় পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। এখন খুলে দেয়ার খবরে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসছে।
দেবতাকুম পরিচালনা কমিটির সভাপতি নুচোমং মারমা বলেন, কখন দেবতাকুম ভ্রমণে পর্যটকদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে সেই আশায় পাড়াবাসী। খুলে দেবার খবরে রাস্তাঘাট এবং নৌকা বাঁশের ভেলা ঠিকঠাক করা হচ্ছে। দর্শনীয় এই পর্যটন স্পটের জন্য ৫২ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা কমিটি এবং ৯৬ জন পর্যটক গাইড রয়েছেন। একইসঙ্গে দেবতাকুম এলাকায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা করার কাজ করছি। ইতিমধ্যে বাঁশের ভেলা ৫০টি ও ৫টি নৌকা প্রস্তুতের কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বান্দরবানে জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, নিরাপত্তা বিবোচনায় রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি তিনটি উপজেলায় আজও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। তবে পর্যটন শিল্প হচ্ছে এই অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। পর্যটনের সঙ্গে এখানকার কৃষি, হস্তশিল্প, কোমর তাঁত, পরিবহনসহ সবকিছু জড়িত। তাই পর্যটনের উন্নয়নে প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও একসঙ্গে কাজ করে। পাহাড়ের সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় নিরাপত্তা গতবছরের এপ্রিলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। আইনশৃংখলা বাহিনীও পর্যটন খুলে দেবার বিষয়ে সম্মত। পরিস্থিতি বিবোচনায় ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সপ্তাহে পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য দেবতাকুম খুলে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। ভ্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে বন্ধ থাকা অন্যান্য স্থানগুলোও খুলে দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।