‘আঁপনা মাংশে হরিণা বৈরী’ এটি বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের একটি পদ। এর অর্থ হলো নারীর শত্রু নারীরাই। এটি আমরা শুনে আসছি দীর্ঘদিন ধরেই। চার দেয়ালে আবদ্ধ নারী যখন ধীরে ধীরে কঠিন বেড়াজাল ছিন্ন করে আপন মহিমায় নিজেদের বিকশিত করেছে, শিক্ষাদীক্ষা আর মননচর্চায় পুরুষের সমকক্ষ হয়ে দেশ ও সমাজে অবদান রাখছে, তাদের বীরত্বগাথা আর অর্জনের কোনো কাহিনী ফুটে ওঠেনি সাহিত্যিক, কবি কিংবা শিল্পীর আঁচড়ে।
নারী দুই অক্ষরের একটি শব্দ, যার রয়েছে বহু সমার্থক শব্দ। নারী, মেয়েছেলে, মহিলা, ললনা, তনয়া, রমণী, কামিনী, প্রমদা, জেনানা, শর্বরী আরো কত কত কী! একই সাথে নারীর প্রতি অসংবেদনশীল বহু শব্দ যেমন: অপয়া, অলক্ষুণে, অভাগী, অবলা, কুলোটা এরকম বহু শব্দ আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে যেখানে পুরুষবাচক কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অর্থাৎ শব্দগুলো শুধু নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই আবহমমান কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এভাবেই নারী সবসময় হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় সমাজে। এই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের শিল্পী সাহিত্যিকদের সৃষ্টিতেও। অথচ আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা বলতে জেন্ডার বৈষম্যহীন সুশীল নারী পুরুষের সম মর্যাদায় অংশীদারিত্বশীল সমাজকেই আমরা বুঝি। নারীর প্রকৃতিগতভাবে নির্ধারিত শরীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের বদলে সামাজিকভাবে সৃষ্ট বৈষম্যের কারণে আমাদের শিল্পে ও সাহিত্যে নারীদের প্রতিকৃতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে কবি সাহিত্যিকদের সাংস্কৃতিক কলাকৌশলে স্ববিরোধী হতে দেখা যায়। আমাদের সমাজে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চিন্তা চেতনা বিকাশে নারী ছিল বাস্তব বহির্ভূত এক স্বপ্ন বা ফ্যান্টাসি। নারীদের অধিকার, সমমর্যাদা বা অর্জন খুব কম কবি সাহিত্যিকদের স্পর্শ করেছে। সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপট, জনপ্রিয়তা বা বাণিজ্যমূল্যের কথা বিবেচনা করে হয়তো নারীবাদী লেখায় তারা স্ববিরোধিতার আশ্রয় নিয়েছে। কবি কালী প্রসন্ন ঘোষ নারীদের অবরুদ্ধ রেখে দেশকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয় ভেবেই বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি আবার প্রচার করেছেন, নারীদের বুদ্ধি কম। ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রহিতকরণে ভূমিকা রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বিধবাবিবাহ প্রবর্তনে তাকে জোরালো কোনো ভূমিকা রাখতে দেয়া হয়নি। নারী সক্ষমতায় বিশ্বাসী সমকালীন সময়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক এমন কি সাহিত্য রচনায়ও স্ববিরোধী ছিলেন। শরৎচন্দ্র তার ত্রিশটি উপন্যাস ও গল্প সংকলনে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বন্দিনী ধর্মীয় শাসনের বলি, দুর্বল, অবরুদ্ধ ও শোষণের বস্তু নারী চরিত্রগুলোকে সাজিয়েছিলেন ভালোবাসা, প্রেম প্রীতি, স্নেহ মমতা অথবা করুণা, দয়া আর ত্যাগের বিমূর্ত মূর্তি হিসেবে। তাঁর রচনায় নারীচরিত্রগুলো উদাসীন, প্রতাপশালী নিষ্ঠুর পুরুষ দ্বারা উপেক্ষিত ও নির্যাতিত হয়েও ঘুণেধরা সমাজের পুরুষতন্ত্র কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে যাবতীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সমসাময়িক কালে বেগম রোকেয়া, আশাপূর্ণা দেবী এবং নবাব ফয়জুন্নেছা সমাজ পরিবর্তনে অনেক অবদান রাখলেও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব সমকালীন সাহিত্যিকদের কলমে উঠে আসেনি। বেগম রোকেয়া তার ‘সুলতানার স্বপ্নে‘ এমন নারীশক্তি কল্পনা করেছিলেন, যারা পুরুষ থেকেও এগিয়ে ছিলেন। তার কল্পিত নারীরা ছিল আধুনিক এবং বিজ্ঞানমনস্ক। অন্যদিকে তসলিমা নাসরীন তার ‘শোধ’ উপন্যাসে বলেছেন, স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী–ও পরকীয়া করতে পারেন। নারীবাদী এই দুই লেখকের আদর্শ আর নৈতিকতা পরস্পর বিরোধী। ঠিক একই ভাবে নাটক আর চলচ্চিত্রেও নারীকে সবসময় নেতিবাচক হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। নারীর শরীরকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন, হত্যা, ধর্ষণ এর দৃশ্য ছাড়াও নারী–শরীরকে পণ্য হিসেবে চিত্রজগতে নেতিবাচকভাবে প্রদর্শনের সংস্কৃতি দীর্ঘদিনের। একইভাবে বিজ্ঞাপন চিত্রেও নারী বিবেচিত পণ্য হিসেবে। একজন সাহিত্যিক যেমন তার লেখার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারেন, ঠিক একইভাবে একজন সাহিত্যিকের মতো একজন সংস্কৃতিকর্মীও তাদের নানামুখী কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে নারীর পথ চলার পথ সুগম করতে পারেন। আবহমান কাল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত নারীর যে অর্জন আর সাফল্যগাথার গল্পকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে পারেন। দয়া, অনুকম্পা আর করুণা না করে নারীদের কাজের যথার্থ মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।