ফোঁড়ন- শব্দটি আমাদের দৈনন্দিন রন্ধনশালায় ব্যবহৃত একটি কৌশল যা তৈরিকৃত খাবারে নিয়ে আসে অন্যমাত্রার স্বাদ, ঝাঁঝ এবং সুগন্ধ। এটি বিভিন্ন মশলার মিশ্রণ। পাঞ্জাবে একে বলা হয় তরকা, হিন্দিতে ছোঙ্ক, বাংলায় বলে ফোঁড়ন আর তেলেগুতে বলে তালিম্পু। রান্নার শেষে ফোঁড়ন শুধু রান্নাকে ভিন্নস্বাদে রূপায়িত করে তা নয়, যোগ করে ভিন্ন আমেজ। মশলার সুগন্ধি আর ঝাঁঝ মিশে রান্নার স্বাদ বেড়ে হয় দ্বিগুণ। এতে রাঁধুনি নিজেও রান্না করে যেমন তৃপ্ত হয়, তেমনি যারা সেই রান্নার স্বাদ গ্রহণ করেন তারাও চেটে পুটে স্বাদ গ্রহণে মত্ত থাকেন। তাই ফোঁড়ন একটি সুস্বাদু রন্ধন কৌশল।
কিছু মশলা মিশ্রিত ফোঁড়ন যদি একটি সাবেকী বা আধুনিক রান্নাতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে, ঠিক তা আর্থসামাজিক জীবনেও উন্মোচন করতে পারে নতুন দ্বার। তবে এক্ষেত্রে ফোঁড়ন হবে মশলা রূপক অর্থনৈতিক, সামাজিক, রীতিনীতি,আচার অনুষ্ঠানের মিশ্রণ। যেমন বলা যায়- কোন রেস্তোরাঁয় বুফে খেতে গেলে যদি খাবারের স্টার্টার হয় (ইকোনমিক্স + সাইকোলজি), আর মেইন কোর্স শুরু করি (ইকোনমিক্স + কালচার) আর সবশেষে ডেজার্ট শুরু করি (ইকোনমিক্স + সোশ্যাল পলিসি) দিয়ে।
সামপ্রতিক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (অভিজিৎ ব্যানার্জী নামেই পরিচিত) Chhaunk: On Food, Economics and Society- প্রকাশিত বইতে Chhaunk (আক্ষরিক অর্থে ফোঁড়ন) শব্দটির মেলবন্ধন করেছেন খাবার, অর্থনীতি এবং সমাজের মধ্যে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন ফোঁড়ন যেমন রান্নাতে বাড়তি স্বাদ আনতে পারে, তেমনি ফোঁড়ন যদি আমরা আমাদের অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থানে, নীতি নির্ধারণে যোগ করতে পারি তবে অর্থনৈতিক কাঠামোর যেমন নতুন রূপ নিতে পারে তেমনি সামাজিক কাঠামোতেও যোগ করতে পারে ভিন্ন মাত্রা।
আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি আমাদের মা দাদিরা লাউয়ের খোসা ফেলে না দিয়ে তা দিয়ে লাউয়ের খোসা ভাজি, ভর্তা করে নতুন নতুন পদ রান্না করেন। ভাবতেই অবাক লাগে তারা কিন্তু কেউ অর্থনীতিবিদ নন কিন্তু তখন থেকেই নারীদের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনায় জিরো ওয়েস্ট বা শূন্য অপচয় ধারণার জন্ম হয়েছিল যা বংশ পরম্পরায় প্রতিটি ঘরের নারীরা বহন করে চলেছে যার সফল প্রতিফলন হতে পারে আজকের টেকসই উন্নয়নের বা স্থায়িত্বের ধারক এবং বাহক।
ড. অভিজিৎ বলেন, অর্থনীতি বিষয়টিকে শুধুমাত্র সংখ্যাভিত্তিক বা অর্থভিত্তিক রসবিহীন বিষয় ভাবা ঠিক নয়। এর মাঝেও ও যে নানা বৈচিত্র্য আছে যা আমাদের মানব অভিজ্ঞতা ও জীবন অভিজ্ঞতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি তাঁর বইতে খাদ্য, অর্থনীতি, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির মাঝে একটি তুলনামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি ও কৃষ্টি প্রতিনিয়ত রূপ পরিবর্তন করে থাকে, এবং একে অপরকে প্রভাবিত করে। তিনি চিরাচরিত ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে একটি মনোমুগ্ধকর উদাহরণ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন ফোঁড়ন শব্দটি ব্যবহার করে। বাঙালি স্বভাবজাত রূপেই রন্ধনপটু, নানা কৌশল গ্রহণে অভিজ্ঞ ও বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন।
ড. অভিজিৎ অর্থনীতির বিভিন্ন লেনদেনের ওপর আস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্ক কী করে অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে সহযোগিতা করে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা এবং সামাজিক অনুশীলনের মাঝে মিশ্র ভূমিকা পালন করে তা ব্যক্ত করেছেন। বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি হুন্ডি ফাইনেন্সিয়াল ট্রান্সফার সিস্টেম (ট্রাস্ট এন্ড ট্রেড) নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বিনিময় মূলত মানবকেন্দ্রিক, যা প্রথমে মানুষ এবং পরে অর্থনৈতিক এজেন্টের মাঝে ঘুরপাক করে।
তাই আমাদের চিন্তা ধারণায় যোগ করতে হবে ফোঁড়ন। নিত্য নতুন পোশাকে নিজেকে উপস্থাপন না করে টেকসই কাপড় (সুতি কাপড়) বার বার পরার বা ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে পরার মানসিকতা গড়তে হবে। এতে অসম্মান নয় বরং এই পৃথিবীতে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার ব্যবস্থা করতে একমাত্র আমরাই পারি। শুধু যোগ করতে হবে আমাদের সুস্থ বিচার, বিচক্ষণতা। অতিরিক্ত জমকালো পোশাক, প্রতিনিয়ত নতুন পোশাক আমাদের মনকে অসুস্থ করছে পাশাপাশি আমাদের পৃথিবী হচ্ছে আবর্জনার ভাগাড়। একটু চিন্তা করে দেখি কেন আমরা এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করি? কার জন্য করি? সাধারণ জীবনই সুন্দর, আর সাস্টেইনেবল(স্থায়ী)।
সকল অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদের কাছে তাই ফোঁড়ন একটি সতেজ এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলন যেখানে এই জটিল পৃথিবীতে কীভাবে আমরা বাঁচি, খাই এবং সম্পৃক্ত হই একে অপরের সাথে। আর যারা খাদ্য রসিক, এই পৃথিবীতে রয়েছে নানান মানুষের, আর তাদের নানান খাবারের ব্যঞ্জন, রেসিপি, যা নিয়ে পরীক্ষা চলছে অবিরত। সবাই যার যার খিদে, চাহিদা মেটায় জ্ঞানে, প্রজ্ঞায়, কৃষ্টিতে ও খাদ্যে।
সকালে ঘুম ভেঙে এক কাপ চা আর খবরের কাগজ-এই দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের সূচনা। কেউ ঘন দুধের চা, পরোটা, লুচি দিয়েও দিন শুরু করে। এটি যার যার রুচি, অভ্যাস আর দিনলিপি। প্রতিটি মানুষের চিন্তা, চেতনায় পার্থক্য আছে, কিন্তু কিছুটা মননের পরিবর্তনে গোটা অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসে। গরম ভাতে কিছুটা আলু মাখা বা আলু ভর্তা সাথে একটু ঘি আর কী চাই? তারপর খাওয়া শেষে একটু মিষ্টিমুখ ( খেজুরের গুড়ের পায়েস) খাবারকে করে সম্পূর্ণ।
এ তো গেল সাধারণ খাবারের বিষয়। এবার ভাবি যৌথ পরিবার বনাম একক পরিবার। ৬০, ৭০ এর দশকে বেশিরভাগ পরিবারই ছিল একান্নবর্তী পরিবার। ঘরে স্থান সংকুলানে ছিল অপ্রতুলতা তবুও একসাথে থাকার মাঝে ছিল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা। ৭০ এর শেষের দিক থেকে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ছোট পরিবারের সূত্রপাত হতে থাকে। একা বেঁচে থাকাকে ভালোভাবে বেঁচে থাকার সূত্র ভেবে সবাই নিজ নিজ আবাসন বাড়াতে থাকে। সত্যিই কি আমরা ভালো আছি? বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ, ঠিক তেমনি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা আর আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ আর সংযুক্তি মানুষকে স্মার্ট করেছে ঠিক কিন্তু পরিবার, পরিজন, সামাজিকতা থেকে দূরে নিয়ে গেছে অনেক বেশি। যোগাযোগের মাধ্যম এখন সোশ্যাল মিডিয়া। বৃদ্ধ বাবা মায়ের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রম। নিজের ভেতরের আমিকে আমরা সাজিয়ে নিচ্ছি একজন কৃত্রিম আমিতে যার কোন শিকড় আছে তা সে ভুলে গিয়ে রঙিন চশমা পরে। ছোটবেলা থেকেই তাই আদব কায়দা, মিশ্রিত ফোঁড়ন এর বড্ড প্রয়োজন আত্মবিকাশে, সামাজিক মননে।
ড. অভিজিৎ তাঁর বইতে জেন্ডার আর রান্নাঘর নিয়েও আলোকপাত করেছেন। তিনি তাঁর একটি অধ্যায়ে লিখেছেন ‘উইমেন এন্ড ওয়ার্ক’ নিয়ে। নারী আর রান্নাঘর যেন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি বলেন নারীমুক্তি এবং বাঙালির সব্জি রেসিপি ঘণ্টের মধ্যে যেমন অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক রয়েছে তেমন রয়েছে শামী কাবাব এবং সেভিংস এর মাঝে। একজন নারী সে গৃহিণী কিংবা কর্মজীবী, দিনশেষে তার স্থান রান্নাঘরেই। নারীর প্রতি একটু সম্মান, শ্রদ্ধা নারীকে উৎসাহ জোগায়, সারাদিনের ক্লান্তিও তার মুছে যায়। তাই সম্মান, সমতা আর সহযোগিতা নামক ফোঁড়ন নারীবান্ধব ক্ষেত্রকে আরো গতিশীল করতে পারে, বাড়াতে পারে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ।
খিচুড়ি খেতে আমরা সকলেই ভালোবাসি। খিচুড়ি তৈরিতে যেমন হরেক রকম ডাল, চাল ও তরিতরকারির মিশ্রণ প্রয়োজন আর রান্না শেষে ফোঁড়ন ব্যতীত খিচুড়ি সম্পূর্ণ হয় না। তেমনি আমাদের এই খিচুড়ি রূপ জটিল দুনিয়ায় হরেক রকমের মানুষের বাস, ভিন্ন তাদের খাবার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এবং সংস্কৃতি। কিন্তু ফোঁড়ন রূপক বিভিন্ন মননের মাঝে আমরা আমাদের জটিল, যান্ত্রিক জীবনকে কিছুটা সহজ করতে পারি, পারি নিজেও বাঁচতে আর অন্যকেও বাঁচাতে। দেশের, দশের পরিবর্তনের পূর্বে নিজের পরিবর্তন আবশ্যক। এর জন্য দরকার আমাদের একাত্মতা, আমাদের সচেতনতার মেল্ বন্ধন, একটু ফোঁড়ন।
লেখক: প্রভাষক, অর্থনীতি বিভাগ, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।