হেমন্ত ঋতু, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি। এই ঋতু বিশেষ করে কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে এক অনন্য আবেদন। তিনি হেমন্তকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, তা আমাদের হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। ‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে-/দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে’–এই লাইনগুলোতে কবির প্রেম ও প্রকৃতির সাথে একটি অন্তরঙ্গ সম্পর্কের চিত্র ফুটে ওঠে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্তের শব্দ ও পরিবেশের উপস্থাপনায় ফুটে উঠে প্রকৃতির নিখুঁত সৌন্দর্য। অন্যান্য কবিরা নগর জীবনের টানে লেখেন, তখন জীবনানন্দ নিবিষ্ট হন জীব–জন্তু, নদী ও গাছপালার জগতে। তাঁর কবিতায় উঠে আসে বুনো হাঁস, ঘাস, হাওয়ার রাত, চালতা ফল, পেঁচা, শঙ্খমালা ইত্যাদি। এসব উপাদানের মাধ্যমে তিনি তৈরি করেন চিত্রকল্প, যা কবিতাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যায়।
জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্তের চিত্র খুবই মায়াবী। যেমন তিনি লিখেছেন, ‘সন্ধ্যা আসে সহসা কখন;/সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম–নিম–নিম কার্তিকের চাঁদে।’ এখানে হেমন্তের উপস্থিতি প্রকৃতির প্রতিটি রূপকে আবদ্ধ করে। কবি হেমন্তের প্রেমে যে পুরো প্রকৃতি হাবুডুবু খাচ্ছে, তা চিত্রিত হয় তাঁর বর্ণনায় : ‘পশমের মতো লাল ফল, কলমীর দানে বেঁধে, চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি–শাদা শাঁখা।’
জীবনানন্দের কাব্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে, হেমন্ত যেন এক অপরূপা সুন্দরী। অঘ্রান–কার্তিক সময়ের বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে নানারূপে। কবি চিত্রিত করেছেন চিল, হরিণ, জোনাকি, বাদুড়, চাঁদ, নক্ষত্র, জল–এগুলো সবই তাঁর কাব্যিক মহিমাকে বাড়িয়ে দেয়। যেমন তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল,’ যা প্রকৃতির গভীরতায় নতুন আলো ফেলে।
হেমন্তের ঘ্রাণ, সুর ও রঙ কবির সৃষ্টিশীলতার চিত্র তুলে ধরে। কবি লিখেছেন, ‘যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,/…আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,/তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই!’ এখানে কবি তাঁর অনুভূতিতে হেমন্তের স্পন্দনকে তুলে ধরেছেন, যা সত্যিই স্পর্শকাতর। তিনি আরও বলেন, ‘আজকের মানুষ আমি তবুও তো–সৃষ্টির হৃদয়ে/হৈমন্তিক স্পন্দনের পথের ফসল।’ এর মাধ্যমে কবি অনুভব করেন যে হেমন্তের প্রভাব মানবজীবনে কতটুকু গাঢ়। তাঁর কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে রূপসী বাংলার বৈচিত্র্যময় দৃশ্য যে কাউকেই আলোড়িত করে, প্রাণশক্তি দেয়।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় রঙের বৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘রোদ্দুরের রঙ শালিকের হৃদয়ের বিবর্ণ ইচ্ছার মতো,’ যা আমাদেরকে রঙের একটি গভীর আবেগ অনুভব করায়। এই রঙের চিত্রকল্পগুলো হেমন্তের প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এক অসাধারণ রূপ তুলে ধরে।
হেমন্তের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য শুধু কবির ভাবনাকে প্রভাবিত করেনি, বরং পাঠককেও মুগ্ধ করে। জীবনানন্দের ‘অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে’ বা ‘মাঠে–মাঠে ঝরে এই শিশিরের সুর’–এইসব লাইন আমাদের মনে গভীরতা নিয়ে আসে। তাঁর কবিতায় প্রকৃতি, সময় ও মানব অনুভূতি এক অসাধারণ নৈকট্য তৈরি করে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় চিত্রকল্প নির্মাণের ব্যতিক্রমী শৈলী আমাদেরকে প্রকৃতির একটি ভিন্ন দিক দেখায়। ‘অপারাজিতার মতো নীল হয়ে,’ কিংবা ‘কামরাঙা–লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো’–এইসব উপমা পাঠককে মুগ্ধ করে এবং জীবনানন্দের কবিতার এক অদ্ভুত সৌন্দর্য প্রকাশ করে। তাঁর কবিতায় হেমন্তের বার্তাও বহন করে। কবি একদিকে আবেগ এবং অন্যদিকে বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন। কবির ভাষায়, ‘আমি এই অঘ্রানেরে ভালোবাসি–বিকেলের এই রং–রঙের শূন্যতা,’ এখানে তিনি প্রকৃতির সৌন্দর্যের সাথে এক গভীর সাদৃশ্য তৈরি করেন।
হেমন্তের প্রভাবে কবি জীবনানন্দ দাশ এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করেছেন। তাঁর কবিতা পাঠককে মুগ্ধ করে, কারণ এখানে রয়েছে একটি অমোঘ আবেগ, যা পাঠককে প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট করে। কবির চিত্রকল্প, শব্দের সুর, এবং আবেগের গভীরতা–সবকিছু মিলে এক অনন্য পাঠ–অভিজ্ঞতা তৈরি করে।
জীবনানন্দ দাশের হেমন্তের কবিতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই ঋতু কেবল একটি ঋতু নয়, বরং আমাদের জীবনধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রকৃতির অনন্ত সৌন্দর্য, রঙের বৈচিত্র্য এবং মানব অনুভূতি–সবই যেন একাকার হয়ে আমাদের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়। এটি আমাদের মনে আনন্দ, বিষণ্নতা এবং জীবনের নানা রূপ নিয়ে আসে, যা কবির শিল্পসত্তার এক বিশেষ প্রকাশ।
ali.proyas2010@gmail.com