‘ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম আউল বাউল ফকির সেজে আমি কোনো ভেক নিলাম না’, ‘মাঝে মাঝে ভাবি চাষারা লাঙলের মুঠি ধরে দেশটা টিকিয়ে রেখেছে, নয়তো অসাধু আমলা, দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিক এবং ফটকা ব্যবসায়ীরা দেশের সমস্ত মাটি মণ মেপে বিদেশে চালান দিত’ (গাভি বৃত্তান্ত)- ‘আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করাতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এত অন্যায়, অবিচার, এত মূঢ়তা ও কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে, এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহযে বোঝা যায় এম কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তুলে না (বুদ্ধবৃত্তির নতুন বিন্যাস) –সাহিত্যিক আহমদ ছফার উক্তিগুলো হৃদয় স্পর্শ করে।
লেখক আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া পেশায় একজন কৃষক এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন দ্বিতীয়।
লেখক আহমদ ছফা দক্ষিণ গাছবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী সম্পন্ন করে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে হতে ১৯৫৭ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বোয়ালখালী কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজেও স্নাতকে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। পরীক্ষা বর্জন করে শেষে ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনার্স অধ্যয়ন ও পরীক্ষা বর্জন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করে পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি গবেষণা (অসম্পূর্ণ) জার্মান ভাষা ডিপ্লোমা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালের জন্য অধ্যাপনাও করেন। ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি শুরু। ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষকসমিতি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। কৃষক আন্দোলন সংগঠনে থাকাকালীন কারাবরণও করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ ও সাপ্তাহিক উত্তরণ, উত্থান পর্বে নিয়মিত লিখতেন। উত্থান পর্বের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন লেখক নিজেই। উত্তরণের প্রধান সম্পাদক ছিলেন। লেখালেখি ও সম্পাদনায় স্বচ্ছতা ও সাহসী ও স্পষ্টবাদিতায় সাংবাদিক মহলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল এক দীপ্তিমান মেধাবী লেখক আহমদ ছফা। তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বাংলা জার্মান সম্প্রীতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
লেখক আহমদ ছফা অর্ধশাতাধিক বই রচনা করেছেন তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বরুমতির আঁকেবাঁকে’। প্রবন্ধসমূহের মধ্যে আছে জাগ্রত বাংলাদেশ, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাংলা ভাষা, রাজনীতির আলোকে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা, বাঙ্গালি মুসলমানের মন, শেখমুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, রাজীতির লেখা, নিকট দূরের প্রসঙ্গ, সংকটের নানা চেহারা, সাম্প্রতিক বিবেচনা, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ, বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র, আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ, সেই সব লেখা ইত্যাদি, উপন্যাস লিখেছেন অনেকগুলো ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ওঙ্কার, গাভীবিত্তান্ত, অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী, পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ, নিহত নক্ষত্র, কবিতার বই ও লিখেছেন, জল্লাদ সময় ও দুঃখের দিনের দোহা, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা, লেনিন ঘুমাবে এবার, আহিতাগ্নি, এছাড়াও কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়া, ভ্রমণকাহিনি, লোকজন ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে, অনুবাদ করেছেন জার্মান কবি গ্যোতের গুতের ফাউস্ট ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা।
আহমদ ছফা শুধু লেখালিখি গবেষণা বা শিক্ষকতা থেমে থাকেনি, মানবিক মানুষ হিসেবে শিল্পীর প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। নিজেই লেখক ও চিত্রশিল্পীকে জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছেন নান্দনিকভাবে। নড়াইলের চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের আঁকা ছবি প্রদর্শনী থেকে শুরু করে প্রচার সবকিছু করেছেন।
গল্প জাদুকর লেখক হুমায়ুন আহমেদকে তাঁর জিয়ন কাঠির আলোতে উদ্ভাসিত করেছেন। হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন, ‘নন্দিত নরকে বই আকারে প্রকাশের সব ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। সাহিত্যের কঠিন মাটিতে আমাকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে তিনি দূরে সরে গেছেন’। শুধু তাই নয়, আহমদ ছফা ছিলেন লেখক হুমায়ুন আহমেদ পরিবারের একজন সদস্যর মতো ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একাত্তরের শহীদ ফয়জুর রহমানের স্ত্রী শহীদ জায়া আয়েশা ফয়েজ ও তাঁর সন্তানদের বাবর রোডের বাসা থেকে রক্ষীবাহিনীরা কম্বল, হাঁড়ি–পাতিলসহ বের করে দেন। সবাই রাস্তায় রাতভর বসে রইলেন। পরদিন খবর পেয়ে লেখক আহমদ ছফা কেরোসিনের টিন নিয়ে আগুন্তকের মতো হাজির, প্রতিবাদ করে বললেন, ‘শহীদ পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে জ্ঞানীর কলমের চেয়েও পবিত্র রক্তকে অবমাননা করা হয়েছে। অপমান করা হয়েছে স্বাধীনতা ও জাতির আত্মদানের গৌরবমণ্ডিত ঐশ্বর্যকে’ রেগে অগ্নিশর্ম প্রতিবাদ করার জন্য লেখক হুমায়ুনকে নিয়ে গণভবনে যাবেন, শহীদ পরিবারকে অপমান করার দায়ে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহুতি দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন এবং খবরটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে, কবি সেকান্দার আবু জাফর এসে আহমদ ছফাকে ধমক দিয়ে বললেন, শহীদ পরিবারের জন্য একটা ব্যবস্থা করবেন। পরবর্তীতে লেখক হুমায়ুন পরিবার আগের বাসায় ওঠার সুযোগ পেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কবি আবুল হাসানের ভর্তি হওয়ার জন্য টাকা ছিল না খবরটি শুনা মাত্র লেখক আহমদ ছফার নিজের লেখা বইয়ের রয়্যালিটি টাকা কবি আবুল হাসানকে দিয়ে দেন। তরুণ কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লা আলসারে আক্রান্ত হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আর্থিক সহযোগিতা করেন। কবি নির্মলেন্দ গুণকে একবার আর্মিরা গ্রেফতার করেন লেখক ছফা খবরটি শুনা মাত্র রমনা থানায় গিয়ে নির্মলেন্দু গুণকে মুক্তির জন্য থানার ওসির সাথে বাকবিতণ্ডা করেন এবং একসময় কবি নির্মলেন্দ গুণ ছাড়া পান। কবি অসিম সাহাকে এম এ পরীক্ষা দেয়ার সময় ভালোবাসার হাত বাড়িয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডক্টর নাজমা শাহীনের বিয়েতে তিনি আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। এরকম অনেক লেখক কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদেরকে তিনি নানা সময়ে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন।
বাংলাদেশে লেখক আহমদ ছফার মতো মানবিক মূল্যেবোধ সম্পন্ন সাহসী ও স্পষ্টবাদী লেখক পাওয়া বড়ো দুস্কর। তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন তিনি। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, মৃত্যু জীবিতদের জন্যে স্পেস সৃষ্টি করে। মৃত্যু সৃষ্টি জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, মৃত্যু জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে’। ২০০১ সালে ২৮ জুলাই বাংলাদেশের সক্রেটিস খ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে প্রস্থান নেন। সাহিত্য জগতের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বিচিত্র দার্শনিকের শেষের ঠিকানা হলো ঢাকা মিরপুর কবরস্থানের ব্লক ক ২৮ লাইন ১০৮৫ নং সাড়ে তিন হাত ছোট মাটির কুটিরে শুয়ে আছেন। তাঁর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক: প্রাবন্ধিক।