ভারতে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার ঘটনায় দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো তদন্ত করছে। আনারের মরদেহের সন্ধান ও হত্যার কারণ জানতে উভয় দেশের কর্মকর্তারা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছেন। আসামিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের লাশ খুঁজে পেতে কয়েক দফা অনুসন্ধানও চলেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের নাগরিক একজন এমপিকে ভারতে হত্যার ঘটনায় বিচার কোন দেশে হবে? কারণ হত্যার স্থান ভারতের কলকাতায় হলেও এর পরিকল্পনা হয় বাংলাদেশে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগী, আসামি, ঘটনাস্থল এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ বিবেচনায় দুই দেশেরই এই হত্যা মামলার বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও রয়েছে। খবর বিবিসি বাংলার।
আইন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : দুই দেশের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, সাধারণত অপরাধ সংঘটনের স্থানে মামলার বিচার হয়। তবে এমপি আনার হত্যাকাণ্ডের ঘটনার যে ধরন তাতে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মামলার বিচার দুই দেশেই সম্ভব বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, এই সুনির্দিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিচার করার দাবিটা করতে পারে। কারণ বাংলাদেশের ভিকটিম, আসামি, মেইন কজ অব অ্যাকশন বাংলাদেশেই উদ্ভূত হয়েছে। শুধুমাত্র ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ভারতে। অর্থাৎ ঘটনা পরিণতি লাভ করেছে ভারতে। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে এই অপরাধের তদন্ত ও বিচার করতে পারবে। এছাড়া বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো ধরনের অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে পারস্পরিক সহায়তার লক্ষ্যে রয়েছে একটি চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশই করতে পারে এই হত্যা মামলার বিচার।
বাংলাদেশে ২০১২ সালে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স ইন ক্রিমিনাল ম্যাটারস অ্যাক্ট নামে একটি আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এর অধীনে একটি নীতিমালাও করা হয়। এছাড়া এই আইনের অধীনে ভারতের সাথে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কনভেনশনও আছে। দুই দেশই এতে স্বাক্ষর করেছে। একইসাথে এই কনভেনশনের অধীনে ২০১৩ সালে দুই দেশ একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ওই চুক্তির ফলে ভারতের কোনো নাগরিক যদি বাংলাদেশে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে ভারতেও এর বিচার হতে পারে। সেক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের শারীরিক বা দালিলিক প্রমাণ, অভিযোগপত্র বা কোনো সাক্ষ্য, এমনকি মৌখিক সাক্ষ্যও দেওয়ার প্রয়োজন হলে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করতে পারবে। একইসাথে যদি বাংলাদেশের নাগরিকরা ভারতে কোনো অপরাধ করে বা শিকার হয় সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ মামলা করতে পারবে। এক্ষেত্রে যেসব দালিলিক বা বস্তুগত প্রমাণ আছে তা তাদের কাছে চাইতে পারবে বাংলাদেশ। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন। সেখানে সিসিটিভির ফুটেজ, বস্তুগত যেসব প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তাও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে। এই চুক্তির অধীনে ভারত এসব দিতে পারবে।
চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার প্রয়োজন হলে ভারত থেকে আসতে পারবে সাক্ষীরা। মামলার সাক্ষী হিসেবে আলামত জব্দকারী কর্মকর্তা, তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই অথবা বিচারের স্বার্থে যাদের সাক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন তারা বাংলাদেশের আদালতে সাক্ষ্য দিতে পারবে। তবে কোনো কারণে সাক্ষীরা বাংলাদেশে আসতে না পারলে ভার্চুয়ালিও সাক্ষ্য নেওয়া যাবে। কারণ এখন বাংলাদেশ এভিডেন্স অ্যাক্ট পরিমার্জন করে ডিজিটালি সাক্ষ্য নিচ্ছে। ফলে অনলাইনেও সাক্ষ্য নেওয়া যাবে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা ও কলকাতা দুই স্থানেই মামলা হয়েছে।
এর আগে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে দুই–তিন মাস আগে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান এ হত্যার পরিকল্পনা করে। যেহেতু আজীম কলকাতায় যাবেন তাই সেখানেই খুন করার পরিকল্পনা করা হয়। আখতারুজ্জামান মার্কিন নাগরিক, একইসাথে আজীমের ব্যবসায়িক অংশীদার।
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, দুই দেশে দুই ধরনের অপরাধের বিচার করলে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা সহজ হবে। যদি মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় তাহলে বাংলাদেশ তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কারণ আমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। কিন্তু ভারত তাকে সে দেশে ফেরাতে পারবে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে।
এর আগে কলকাতা হাই কোর্টের জ্যেষ্ঠ ফৌজদারি আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চ্যাটার্জী বলেছিলেন, অপরাধ যেহেতু ভারতে হয়েছে, তাই এদেশের আইন অনুযায়ীই বিচার হওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে বিচারটা কোন দেশে হবে, তা দুদেশের মধ্যে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।