এস আলমের পোড়া চিনির বর্জ্য যাচ্ছে কর্ণফুলীতে

গুদামে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে দুই-তিন দিন সময় লাগবে : ফায়ার সার্ভিস

পটিয়া প্রতিনিধি | বুধবার , ৬ মার্চ, ২০২৪ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

আগুন লাগার ২৪ ঘণ্টা পার হলেও কর্ণফুলী থানার ইছানগরে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আগুন এখনো জ্বলছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, সেনাবাহিনী ও কোস্টগার্ড। আগুন বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই থেকে তিন দিন সময় লেগে যেতে পারে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক।

এদিকে এস আলম রিফাইন্ড সুগারের চিনির কাঁচামালের আগুনে পোড়া বর্জ্য কারখানার ড্রেন দিয়ে পড়ছে কর্ণফুলী নদীতে। বর্জ্যের কারণে এ এলাকায় নদীর পানি লালনীল বর্ণ ধারণ করেছে। এতে করে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, আগুন থেকে মূল কারখানা রক্ষা করা গেছে। তবে একটি গুদামে থাকা অপরিশোধিত চিনি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুন লাগা গুদামটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। যে কারণে আগুন লাগার পর নেভানো সম্ভব হয়নি।

ঘটনাস্থলে থাকা বান্দরবান ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি বলেন, গুদামে যে পরিমাণ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, এখানে তা নেই। যে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে। এদিকে গুদামটির আগুন নেভার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের নয়টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করছে।

জানা গেছে, গত সোমবার বিকেল ৪টায় লাগা আগুনে ধোঁয়া বের হচ্ছে এখনো। এছাড়া আগুন লাগা পরিস্থিতিকে পুঁজি করে আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও পটিয়ায় উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে এক রাতে বেড়ে গেছে চিনির দাম। গত সোমবার রাত থেকে খুচরা বাজারে চিনির দাম ১৪০ টাকা নিলেও গতকাল ১৪৫১৫০ টাকা করে চিনি বিক্রি করছে বলে ক্রেতারা অভিযোগ করেন।

কারখানার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনিকলটির পাঁচটি গুদাম রয়েছে। প্রতিটি গুদামের ধারণ ক্ষমতা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। কারখানার এক নম্বর গুদামে আগুন লাগে। আগুন লাগার সময় কারখানার উৎপাদন চালু ছিল। এ সময় কারখানাটিতে প্রায় সাড়ে ৫শ শ্রমিককর্মচারী কাজ করছিলেন। আগুন লাগার পর কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক পক্ষের লোকজন ও বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন।

এ ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার সার্বিক ও ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা। গতকাল দুপুরে কর্ণফুলীর ইছানগর গ্রামে অবস্থিত কারখানা পরিদর্শন করেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপক (এমডি) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।

এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মো. আখতার হোসেন বলেন, কারখানার একটি গুদামে আগুন লাগলেও আরও ৪টি গুদাম অক্ষত রয়েছে। তাই দুএকদিনের মধ্যে পুরোদমে উৎপাদনে ফিরে আসতে পারব আমরা। আশা করি বাজারে চিনির দামে প্রভাব পড়বে না।

পোড়া চিনির বর্জ্য যাচ্ছে কর্ণফুলীতে : বিডিনিউজ জানায়, এস আলম সুগার রিফাইন্ডে আগুনে পোড়া গুদাম থেকে গলে যাওয়া অপরিশোধিত চিনি গিয়ে পড়ছে পাশের কর্ণফুলী নদীতে। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বেশিমাত্রায় পোড়া চিনি নদীতে মিশে গেলে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে পোড়া বর্জ্যগুলো সরাসরি নদীতে পড়া ঠেকানো দরকার। তবে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, অপরিশোধিত চিনির বর্জ্যে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না।

কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেক সংলগ্ন ইছানগর এলাকায় ১১ মেগাওয়াটের এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশেই এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিল। পাওয়ার প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ দিয়েই চিনি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম চলে। এ কারখানার দৈনিক পরিশোধন ক্ষমতা ২২০০ টন।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আবদুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, অপরিশোধিত চিনি মূলত কার্বন, হাইড্রোজেন ও অঙিজেনের একটি যৌগ। কার্বন ও অঙিজেন দুটোই আগুন জ্বলতে সহায়তা করে। ৩৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় অপরিশোধিত চিনি গলে গিয়ে ভোলাটাইল কেমিক্যালে (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক) পরিণত হয়। এখন এই আগুন নেভাতে আমরা পানি দিয়ে চেষ্টা করছি।

দুপুরে কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, মূল ফটক থেকে প্রায় চারশ ফুট দূরে এক নম্বর গুদাম জ্বলছে। এক নম্বর গুদামটি ৬৫ হাজার ৭০০ বর্গফুটের। মূল ফটক থেকে গুদাম পর্যন্ত পুরো রাস্তায় অপরিশোধিত চিনি গলে লালচে কালো কাদার মতো তরল ছড়িয়ে আছে।

লাভার মতো ওই তরল ১ নম্বর গুদামের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে গুদামের পশ্চিম পাশে একটি নালায় পড়ছে। নালাটি চলে গেছে নদীর দিকে। গলিত চিনির বর্জ্য ওই নালা দিয়ে সরাসরি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। লালচেকালো তরল মিশে পানির রঙও বদলে যাচ্ছে।

সেখানে কথা হয় এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তিনি ১২ বছর ধরে এ কারখানায় কাজ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, আগুন লাগার পর যে কালো পানিটা বের হচ্ছে, সেটা এখানে নদীতে ছাড়া হচ্ছে। অন্য সময়ও চিনি তৈরির পর যে ময়লা অবশিষ্ট থাকে, সেগুলো এ নালা দিয়ে নদীতে ফেলা হয়। নালাটা করা হইছে ময়লা নদীতে ফেলার জন্য।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এস আলম গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, এটা র সুগার। এখানে ক্ষতি হয় তেমন কোনো কেমিক্যাল নেই। পরিবেশের কোথাও ক্ষতি হবে না। পোড়া র সুগার আমরা ব্র্র্র্যাকেট করে ফেলছি। ড্রেন থেকে ডাম্পিং স্টেশনে যাচ্ছে। নদীতে যাচ্ছে না।

একই ধরনের কথা বললেন ঢাকা থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, র মেটেরিয়াল এখানে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার টন। তারা এমন সিস্টেম রেখেছেন যাতে নদীতে না যায়। আর গেলেও তেমন ক্ষতি হবে না। এটা র সুগার, উপকরণে তেমন ক্ষতিকর কিছু নেই।

তবে ওই পোড়া চিনিতে বিপদ দেখছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনির উদ্দিন। তিনি বলেন, পোড়া অপরিশোধিত চিনির বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ার ফলে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। পানির মাত্রা মান কমে গিয়ে ইকোলজিক্যাল অসামঞ্জস্যতা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে বিওডি (বায়োলজিক্যাল অঙিজেন ডিমান্ড), সিওডি (কেমিকেল অঙিজেন ডিমান্ড) এবং ডিও (দ্রবীভূত অঙিজেন) মাত্রায় হেরফের হতে পারে। পানির মান কমার সাথে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে এবং নদীর জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়বে।

তিনি বলেন, এমনিতেই আমাদের দেশে নদীর পাড়ে যত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে, তারা কোনো ধরনের প্রোটেকশন ছাড়াই সরাসরি বর্জ্য ফেলে। কর্ণফুলীতেও এর ব্যতিক্রম নেই। তবে জোয়ারভাটার নদী হওয়ায় কিছুটা রক্ষা। এজন্য আমাদের তদারককারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী। তার পরামর্শ, নদীর পানি দূষণ বন্ধের জন্য এস আলম সুগার মিল থেকে গলা বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা আটকাতে হবে এবং এবং সেগুলো সঠিক প্রক্রিয়ায় ডাম্পিং করতে হবে।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণাগারের একটি দলও গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। গবেষণাগারের চিফ কেমিস্ট কামরুল আলম বলেন, তারা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখবেন পানির মান কতটা বদলাচ্ছে।

আগুনের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটিও গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে। তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমান বলেন, আমরা আপনাদের কাছ থেকে বিষয়টি জানলাম। আমরা দেখব পরিবেশের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কিনা। নদীতে কোনো আবর্জনা পড়ছে কিনা।

অগ্নিকাণ্ডের প্রভাব চিনির বাজারে পড়বে না : গুদামে আগুন লেগে এক লাখ টন অপরিশোধিত চিনি পুড়ে যাওয়ার কথা বললেও এ কারণে আসন্ন রোজায় চিনির বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে আশ্বস্ত করতে চাইছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপ। গতকাল দুপুরে পুড়ে যাওয়া গুদাম দেখতে এসে এস আলম গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) মো. আকতার হাসান বলেন, অত্যন্ত বেদনার সাথে জানাচ্ছি, গতকাল বিকালে আগুন লেগেছে, এখনো আগুন নেভানো যায়নি। এখানে প্রত্যেকে কাজ করছে। কীভাবে হলো এবং ক্ষয়ক্ষতি কত তা এখন আমরা বলতে পারছি না। তবে এটা নিশ্চিত করতে পারি, বাজারে প্রভাব পড়বে না। আমাদের এখনো ১০১৫ দিনের মতো ফিনিশড (পরিশোধিত) চিনি হাতে আছে।

কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, রোজার মাস সামনে রেখে মিলের চারটি গুদামে মোট চার লাখ টন অপরিশোধিত চিনি মজুদ করা হয়েছিল। পরিশোধনের পর ওই চিনি বাজারে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে ১ নম্বর গুদামের এক লাখ টন চিনি পুড়ে গেছে। রোজা শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে বিপুল পরিমাণ চিনি ভষ্মীভূত হওয়ায় এর প্রভাব বাজারে পড়বে কিনা, সেই আলোচনা চলছে সোমবার থেকে।

আকতার হাসান বলেন, আশা করি দুয়েক দিনের মধ্যে আমরা আবার বাজারে ফিরে আসব। আমাদের পাইপলাইনে ৬৭ লাখ টন চিনি আছে। শুধু একটি গোডাউন পুড়েছে। আরো চারটি গোডাউন আছে। বাজারে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, যে গুদামে আগুন লেগেছে তাতে এক লাখ টন র সুগার ছিল। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়েছিল ওই চিনি।

বাজারে যে প্রভাব পড়বে না, সেটা কীভাবে বোঝা যাচ্ছে জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের জিএম (এইচআর) মোহাম্মদ হোসেন বলেন, রোজায় সারা দেশে এক লাখ টন চিনি লাগে। শুধু আমাদেরই এর চেয়ে অনেক বেশি চিনি আছে। র সুগারের একটা গুদাম জ্বলেছে। তিনটা অক্ষত আছে। আরেকটা গুদাম ফিনিশড সুগারের, সেটাও অক্ষত আছে। আমাদের প্রায় ২৫ হাজার টন পরিশোধিত চিনি রেডি আছে। সেটা ১০১৫ দিনের মতো ফিনিশড গুড। আগুনের কারণে গতকাল থেকে বাজারে ডেলিভারি বন্ধ। আশা করি দুয়েক দিনের মধ্যে আবার বাজারে চিনি দিতে পারব।

সংশোধনী : গতকালের রিপোর্টে কর্ণফুলীর ইছানগরকে ভুলবশত ‘ইছাপুর’ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ইছানগর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিরোধিতার মধ্যেই স্থায়ী হলো দ্রুত বিচার আইন
পরবর্তী নিবন্ধফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বিশ্বজুড়ে বিভ্রাট