বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর সফল শিল্পশস্যের নাম মঞ্চনাটক। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হাসান কিসলু উন্মেষকাল থেকেই সে শস্যমাঠের নিবেদিত শ্রমিক। কালের বর্তমান প্রান্তে এসেও মঞ্চের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। উন্মেষকাল থেকে এখনও তিনি গ্রুপ থিয়েটার নিরবচ্ছিন্ন মঞ্চপ্রেমিক। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধফেরত শিল্পী– এই ত্রয়ী সম্মিলন তাঁর নাট্যজীবনকে অনন্য তাৎপর্যময় মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। নাট্যাঙ্গনে তিনি বিবিধ সত্তায় পরিচিত। তিনি একাধারে সংগঠক, নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যচিন্তক, গবেষক, ভাষাবিদ এবং সুবক্তা।
জিয়াউল হাসান কিসলুর জন্মজনপদ বরিশাল– গৌরনদী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রাম। জন্ম ১৭নভেম্বর ১৯৫৫। পিতা খলিফা আবদুল হাই ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মাতা কানিজ হাবিবা বেগম। চট্টগ্রামের সাথে তাঁর রয়েছে শৈশব কৈশোরের দুরন্ত স্মৃতি। পিতার কর্মসূত্রে দুই বছর বয়স থেকে প্রায় দুই যুগ ধরে তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করেছেন। আগ্রাবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পড়াশুনার পর চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক (১৯৭২) এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে নিয়েছেন উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ (১৯৭৫)। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে। তিনি বাংলা বিভাগের স্নাতক (১৯৭৮) ও স্নাতকোত্তর (১৯৭৯)।
এই বহুমাত্রিক, মেধাবী ও একনিষ্ঠ নাট্যজন চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করেছেন তাঁর নাট্যজীবন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন নাট্যকার অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদের সংস্পর্শ তাঁর নাট্যজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গ্রুপ থিয়েটারে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই তিনি নাট্যচর্চায় যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন তাঁর নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় মমতাজউদদীন আহমদের ‘মাঝখানে ছাতা’ নাটকটি। এ–নাটক দেখতে এসে নাট্যকার তাঁকে উচ্চসিত প্রশংসায় সিক্ত করেন এবং চট্টগ্রামে সদ্য গঠিত নাট্যদল ‘থিয়েটার ৭৩’– এ যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। এ–দলে আগে থেকেই ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মিজানুর রহমান লাভলু, সদরুল পাশা, নাট্যকার হাবীব আহসান কোহিনুর প্রমুখ। মমতাজ স্যারের আহ্বান এবং উল্লেখকৃত তিনজনের সম্মতি ও সহযোগিতায় জিয়াউল হাসান কিসলু দল গঠনের দুই মাসের মধ্যে ‘থিয়েটার ৭৩’–নাট্যদলে যোগ দেন। এর পর প্রায় দশ বছর ধরে এ–দলের অভিনয়, নির্দেশনা, প্রকাশনাসহ সাংগঠনিক বিবিধ কর্মে তিনি যুক্ত ছিলেন।
থিয়েটার ৭৩–এর কর্মকান্ডে এবং তাঁর সমগ্র নাট্যজীবনের প্রধান পরিচয় অভিনেতা হিসাবে। থিয়েটার ৭৩–এর তৃতীয় প্রযোজনা থেকে তিনি অভিনয়ে যুক্ত হন এবং চট্টগ্রামে অবস্থানকালীন এ–দলের প্রযোজনা হাবিব আহসান কোহিনুর রচিত ‘তরুণ ও বহমান ক্ষত’ ‘পলাতক পালিয়ে গেছে’ ‘সাক্ষাৎকার’ এবং মমতাজউদদীন আহমদ রচিত ‘হরিন চিতা চিল’ ‘ফলাফল নিম্নচাপ’ প্রভৃতি নাটকে তিনি অভিনয় করেছেন। তাঁর প্রমিত ও স্পষ্ট উচ্চারণ, চরিত্র নির্মাণে সহজাত দক্ষতা, সাবলীল অভিনয় সমকালীন দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর অভিনয় তৎকালে দর্শকদের প্রশংসা লাভ করেছে। বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে সুপরিচিত অভিনেতা জিয়াউল হাসান কিসলু চট্টগ্রামে থাকাকালেই নিজের মেধা, প্রচেষ্টা, দর্শকের ভালোবাসা এবং বিভিন্ন নাটকে বৈচিত্রপূর্ণ অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জীবনের মজবুত ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি দলের নাটকে নির্দেশনার দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। থিয়েটার ৭৩–এ তাঁর নির্দেশিত নাটক হলো– ‘দরোজায় করাঘাত’ (যৌথভাবে), ‘এলেবেলে’ প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, ১৯৭৭ সালে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত নাট্য–উৎসবে ‘এলেবেলে’ ‘কৃতিত্বপূর্ণ প্রযোজনা’ এবং এ–নাটকের অভিনেত্রী রাহনুমা আফতাব নিশো ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী’ হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন। পুরস্কার দুটির প্রতিটির আর্থিক মূল্যমান ছিল দুই হাজার টাকা। এক পর্যায়ে দল পরিচালনার গুরুদায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। থিয়েটার ৭৩–এর ১৯৮১–১৯৮২ মেয়াদের কার্যকরী পরিষদে সভাপতি শাহ আলম নিপুর সাথে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ছিলেন জিয়াউল হাসান কিসলু।
১৯৮২ সালে তিনি দুই দশকের স্মৃতি বিজড়িত– স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকা শহরে স্থায়ী হন। ঢাকায় এসে তিনি যুক্ত হয়ে যান বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নাট্যদল ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’–এর সাথে। এখানেও তিনি মুলত অভিনেতা হিসাবে ভূমিকা রাখেন। নাগরিকের সাড়া জাগানো নাটক আলি যাকের নির্দেশিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’; আসাদুজ্জামান নূরের রূপান্তর ও নির্দেশনায় বার্টোল্ড ব্রেখটের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, সারা যাকেরের রূপান্তর ও নির্দেশনায় দারিও ফো ও ফ্রাঙ্কা রামে রচিত ‘ওপেন কাপল’ (সহ–অভিনেতা সারা যাকের) প্রভৃতি নাটকে তিনি অভিনয়ের প্রাতিস্বিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অভিনয়ের জন্য তিনি দেশে এবং দেশের বাইরে– ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এবং ইংলেন্ডে দর্শকের বিপুল প্রশংসা পেয়েছেন। নাগরিকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে নিবিড় নাট্যচর্চায় তিনি যুক্ত ছিলেন। ২০২২ সালে তিনি এ–দলের সমূদয় কর্মকাণ্ড থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দেন। নাট্যজীবনের প্রান্তে এসে– চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গন নিয়ে তিনি তীব্র স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। চট্টগ্রাম থাকাকালীন থিয়েটার ৭৩–এর সাথে নাট্যচর্চার সময়গুলো নিয়ে তিনি গর্ববোধ করেন। পঞ্চাশ বছর আগে এ–দলের সাথে তাঁর যে আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে আজও তা তাঁর ভাবনা ও স্মৃতির জগতে উজ্জ্বল ও অটুট রয়েছে। দলটির কার্যক্রম এখন না থাকলেও এ–দলের একজন সদস্য, একজন অভিনেতা ও একজন নির্দেশক হিসাবে পরিচয় দিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ ও গর্ববোধ করেন। মঞ্চ ছাড়াও তিনি রেডিও, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র মাধ্যমে অভিনয়ের সাথে যুক্ত আছেন। তাঁর অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘শেখমুজিব– একটি জাতির রূপকার’ এবং মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে রোকেয়া প্রাচী পরিচালিত ‘জয় বাংলা ধ্বনি’। সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করলেও অল্পকিছুদিন পর তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসাবে যোগ দেন (১৯৮৪)। কর্মসূত্রে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ও প্রশাসনিক দায়িত্ব ছাড়াও তিনি নায়েম ও এনসিটিবি–তে বিভিন্ন মেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। এ–সময় তিনি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন ও সংশোধন এবং দেশব্যাপী শিক্ষা ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ কর্নার স্থাপনের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষা ক্যাডারে ৩৪ বছর দায়িত্ব পালন করে ২০১৮ সাল থেকে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।
জিয়াউল হাসান কিসলু নাট্যচিন্তা, ও নাট্যপ্রকাশনায় মনোযোগী ছিলেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রকাশিত নাটকের কাগজ নাট্যপত্র–এর তিনি ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। থিয়েটার ৭৩ প্রকাশিত মঞ্চ নাট্যপত্রের প্রথম তিন সংখ্যার তিনি সহসম্পাদক ছিলেন। এ–পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি নিবন্ধ। একটির শিরোনাম ‘চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা’ এবং অন্যটি ‘একুশ, কবর এবং মুনীর চৌধুরী’। প্রসঙ্গত, ‘মুনীর চৌধুরীর নাটক’ (১৯৯১) শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র গবেষণা গ্রন্থ।
বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সংগ্রামের সাথে জিয়াউল হাসান কিসলুর রয়েছে প্রত্যক্ষ ও বীরত্বপূর্ণ সম্পর্ক। দশম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন মাত্র ১৬বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি ৯নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত বরিশালের গৌরনদী থানা কমান্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মনে করেন এ–যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি– বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদমুক্ত, অসাম্প্রদায়িকও ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা পর্যন্ত এ–যুদ্ধ চলতেই থাকবে। প্রগতিশীল নাট্য ও সংস্কৃতিচর্চা সে যুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসাবে আমাদের অনুপ্রণিত করবে।
পরিবর্তনকামী ইতিবাচক চিন্তা এবং নাট্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে প্রগতিশীল ভূমিকার কারণে জিয়াউল হাসান কিসলু লাভ করেছেন বেশকিছু সম্মাননা। তম্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ‘শম্ভুমিত্র স্মৃতি সম্মাননা’ (নিখিলবঙ্গ বাচিক সংসদ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ), ‘শ্রেষ্ঠ প্রধান চরিত্র পুরস্কার ২০১৭’ (স্টার অ্যাওয়ার্ড, আরটিভি), ‘নাট্যজন সৈয়দ মাহিদুল ইসলাম মঞ্চবন্ধু সম্মাননা ২০২২’, মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য– ‘বিশেষ সম্মাননা ২০১০’ (জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি–নায়েম)।
চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার উন্মেষ ও বিকাশপর্বের বিশ্বস্ত ও মহান এই নাট্যব্যক্তিত্ব গত পঞ্চাশ বছর নাট্যাঙ্গনে নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা পালনের স্বীকৃতি হিসাবে ‘নাট্যকার চৌধুরী জহুরুল হক সম্মাননা’ লাভ করায় তাঁকে হার্দ্য অভিনন্দন জানাচ্ছি। শিল্পের কাছে, সুন্দরের কাছে সর্বোপরি দেশমাতৃকার কাছে সমর্পিত এই মহৎ মানবজীবনের কল্যাণ হোক।
লেখক : নাট্যজন, প্রাবন্ধিক, গবেষক