খুব বেশিদিনের কথা নয়, বলছি লিঙ্ক রোড চালু হওয়ার আগের কথা। অফিসের কাজে প্রায়ই ছুটতে হতো দেশের বাইরে, আবার কখনো শুধু ঢাকা। বেশিরভাগ সময় ঢাকায় ফার্স্ট ফ্লাইটে গিয়ে কাজ সেরে বিকেলের ফ্লাইটে নয়তো লাস্ট ফ্লাইটে ফিরতে হতো। যাওয়ার সময় তেমন ঝামেলা হতো না, ইপিজেড এর কাছে একটু যানবাহনের জটলা, গার্মেন্টস কর্মীদের ভিড় থাকলেও, ওই সময়টাকে হাতে নিয়ে বের হলে সমস্যা হতো না। কিন্তু ফেরার সময় জ্যামে বসে থেকে থেকে কান্না পেত। সারাদিনের খাটুনির পর ক্লান্ত শরীরে দু–তিন ঘন্টা ট্রাকের জ্যামে বসে থাকাটা দুর্বিষহ মনে হতো। লিংক রোড হওয়ার পর থেকে ওই পুরানো রাস্তা দিয়ে আর এয়ারপোর্টে যাইনি। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে লিংকরোড হয়ে সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে, সাঁই করে যেদিন প্রথম এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাই, সেই দিনই ওই রাস্তাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। দেশের বাইরে গেলে মনটা খুব খারাপ হতো ওদের রাস্তাগুলো দেখে, সাজানো গোছানো আশপাশ দেখে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে, সুশৃঙ্খলতা দেখে। সবসময় মনে মনে ভাবি, সাগর পাহাড় নদী দিয়ে ঘেরা অপরূপ আমাদের এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের বড় সম্পদ। এই ফেলে আমরা অবসর যাপনের জন্য ছুটে যাই আশপাশের দেশে।ওদের উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ভ্রমণ আনন্দদায়ক করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মন স্বপ্ন দেখতে চাইতো, কিন্তু ভাবিনি সত্যি হবে কোনদিন! কক্সবাজার ঘুরে ফিরে আসার সময় সমুদ্র থেকে আহরণ করে আনা আনন্দ ম্লান করে দিত অপ্রশস্ত রাস্তার ক্লান্তিকর জার্নি। এবার ভ্রমণ সুন্দর করে উপভোগ করেছি সুন্দর রাস্তার জন্য। নিয়ন কালারে অংকিত চিহ্নগুলো পুরো রাস্তা আলোকিত করে পথনির্দেশ করছিল সন্ধ্যার পর থেকে। রাস্তা প্রশস্ত হওয়াতে কোন জ্যাম পাইনি পথে, তবে দুর্বল ট্রাফিক, ড্রাইভারদের অস্থিরতা, এলোমেলো পার্কিং এসব বিশৃঙ্খলার কারণে নতুন ব্রিজের কাছে এসে প্রায় আধঘন্টা বসে থাকতে হয়েছে। আগে বা পরে কোন জ্যাম ছিল না, শুধু এক জায়গায় সব জটলা পাকিয়ে ছিল।
গত সপ্তাহে ভাইকে নামাতে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম। অবরোধের ঝামেলা এড়াতে ড্রাইভার আগ্রাবাদ হয়ে এয়ারপোর্টে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বাধা না দিলেও মনে মনে শংকিত ছিলাম সময়ে বিমানবন্দরে পৌঁছাবার বিষয়ে। অনেকদিন ওই পথে না যাওয়ার কারণে সব নতুন নতুন লাগছিল, মসৃণ রাস্তা, সুন্দর ফ্লাইওভার/কালভার্ট (যদিও এখনো অনেক কাজ বাকি), ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছি গন্তব্যে। হালিশহরের দিকেও সুন্দর ফ্লাইওভার দাঁড়িয়ে গেছে, চকবাজার দিয়েও সুন্দর একটা রাস্তা হয়েছে যা দ্রুত নতুন ব্রিজে পৌঁছে দেয়। অনেক বছর পর চট্টগ্রামকে এখন নতুন নতুন লাগছে, বদলে যেতে দেখে সত্যিই মন আনন্দিত, মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে। কিছুদিন পর খুলে যাবে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আরোও কিছুদিনপর জলাবদ্ধতা নিরসনে যে মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে, তাও শেষ হবে, বর্ষায় আমাদের দুর্ভোগ আশাকরি অনেকাংশে কমে যাবে। শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামগুলেতেও প্রচুর রাস্তার কাজ হয়েছে, নতুন নতুন রাস্তাগুলো যাতায়াতের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচিত করছে। সবার নজর এখন কক্সবাজারের আইকনিক রেলওয়ে স্টেশনের দিকে।
ঢাকা–কক্সবাজার রেল যোগাযোগ, মাতার বাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দর আমাদের চট্টগ্রামকে বদলে দিচ্ছে, আমাদের সর্বকালের আক্ষেপ ‘পোর্ট সিটি হওয়া সত্ত্বেও অবহেলিত চট্টগ্রাম’ বলার দিন বুঝি ফুরিয়ে আসছে। হ্যাঁ সবার মত আমারও মনে আক্ষেপ রয়েছে নড়বড়ে কালুরঘাট সেতু নিয়ে, আশা করবো সরকারের নজর এবার আমাদের বহুলাকাঙ্ক্ষিত অবহেলিত কালুরঘাট সেতুর দিকে পড়বে।
শুধু চট্টগ্রামে নয়, উন্নয়নের জোয়ারে পুরো দেশে এখন সাজ সাজ রব। বিশ্বমানের প্রচুর রাস্তা, সেতু, কালভার্ট হয়েছে দেশে, যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সাথে বদলে যাচ্ছে দেশ। বিশ্বমানচিত্রে অংকিত সেই ছোট্ট বাংলাদেশকে একসময় কেউ চিনতো না, হেয় প্রতিপন্ন করতো, পরিচয় ছিল মিস্কিন! এখন বাংলাদেশকে সবাই চেনে, জানে এবং মানে। অনেক দেশ অনুকরণীয় মনে করছে আমাদের দেশকে।
তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, দেশের বাইরে আমাদের আচার আচরণ, চালচলন সভ্য হলেও, দেশে আমাদের চালচলন, আচার আচরণ অশিক্ষিত, অসভ্যের মত! দেশটাকে ভালোবাসার লোকের বড্ড অভাব।
এখন সময় আমাদের নিজেদের বদলাবার। আমরা যদি নিজেদের স্বভাব বদলাতে না পারি, দেশটাকে না ভালোবাসি, তাহলে সব সুন্দর অসুন্দরে পর্যবসিত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
দেশকে বদলে দেয়ার জন্য জননেত্রী শেখ হাসিনা কাজ করেছে প্রচুর, এখন এর সৌন্দর্য রক্ষায় আমাদেরই কাজ করা আমাদের দায়িত্ব। সর্বাগ্রে ট্রাফিক আইন কড়াকড়ি এবং যথাযত প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। যেখানে সেখানে পার্কিং, গণপরিবহন থামিয়ে যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা বন্ধ করলে রাস্তায় শৃঙ্খলা আসবে। রাস্তায় বের হলেই ‘কার আগে কে যাবো’ এই মনোভাব ত্যাগ করতে হবে সর্বাগ্রে। এর সাথে আমাদের রক্তে মিশে আছে যত্র তত্র ময়লা ফেলার অভ্যাস, এই অভ্যাস পরিবর্তন অত সহজ হবে না, এর জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে পুরো শহর ডাস্টবিন ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। দিনে কোন ময়লা তোলার কাজ নয়, এ কাজ করতে হয় রাতে। আমাদের আরেকটা বড় সমস্যা হলো– পর্যটনকেন্দ্রগুলোর আশেপাশে অপরিকল্পিত অস্থায়ী দোকানপাটে জায়গাটার সৌন্দর্য মাটি করে দেয়া। দোকান পাট, হকার অবশ্যই থাকবে, তবে তা হতে হবে পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন। তারা যদি নিজেদের জায়গাটুকু নিজেরা পতেঙ্গায় দেখলাম দোকান পর্যটকদের বসবার জায়গা দখল করে নিয়েছে, অন্যদিকে হাইওয়ে পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে এই অশুভ হাত। নিউমার্কেটের আশেপাশে অর্ধেক রাস্তাজুড়ে এখনো প্রচুর দোকান। অনেক জায়গায় ফুটপাথের ওপর সারিসারি দোকান। এগুলো একদিকে যেমন পথচারী চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, অন্যদিকে অপরিচ্ছন্ন একটা পরিবেশ গড়ে তোলে।
এখন আমাদের নিজেদের সভ্য করে তোলার পালা, আসুন ডাস্টবিন ব্যবহারে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলি, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি। সুন্দর দেশটাকে আরো সুন্দর না করতে পারলেও অসুন্দর যেন না করি। আজ নিজেকে বদলাই, কাল সবাই বদলাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার