অবশেষে চট্টগ্রাম বন্দরের নবনির্মিত পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি) পুরোদমে চালু হচ্ছে। আগামী ১৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টার্মিনালটি উদ্বোধন করবেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন টার্মিনালটি সৌদি রাজ পরিবারের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা করার কথা রয়েছে।
পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় ইতোমধ্যে দুই প্রতিষ্ঠানের আলাপ আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। দেশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ দেখালেও শেষতক সৌদি প্রতিষ্ঠানটিকে টার্মিনালটি দেয়া হচ্ছে। টার্মিনালটি পুরোদমে চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের ২০০ মিটারের বেশি লম্বা জাহাজ অনায়াসে বার্থিং নিতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনারসহ পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে পিসিটি অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। টার্মিনালটির নির্মাণকাজ বেশ কয়েকমাস আগে সম্পন্ন হলেও এটি চালু করা যাচ্ছিল না। টার্মিনালটিতে ছোটখাটো কিছু জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হচ্ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন এবং প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট স্থাপন না করায় টার্মিনালটি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে উঠেছিল এটির পরিচালনার ধরণ নিয়ে। এটি কি বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করবে নাকি বেসরকারি অপারেটর দিয়ে চালাবে সেটি নিয়েও সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। আবার প্রাইভেট অপারেটর কি দেশি হবে নাকি বিদেশি হবে সেটি নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা। ইকুইপমেন্ট কি বন্দর কর্তৃপক্ষ স্থাপন করবে নাকি অপারেটর কিনবে সে প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা চলছিল। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের শীর্য পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর দেশি–বিদেশি ইস্যুটি মূখ্য হয়ে উঠেছিল। বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর কোন দেশের অপারেটর নিয়োগ দেয়া হবে তা নিয়েও নানা সমীকরণ মেলানো হয়।
অবশেষে সব আলোচনা এবং হিসেব নিকেশ চূড়ান্ত করে আগামী ১৪ নভেম্বর পিসিটি উদ্বোধন করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে চট্টগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন।
টার্মিনালটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে সৌদি আরবের ‘রেড সি গেটওয়ে’ নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করবে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের আগে কিংবা পরে সৌদি রাজ পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘রেড সি গেটওয়ে’র সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, আগামী ১৪ নভেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টার্মিনালটি উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনের পরই এটিকে পূর্ণাঙ্গ অপারেশনে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে। সৌদি প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তাদের সাথে চুক্তি হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র বলে উল্লেখ করে মোহাম্মাদ ওমর ফারুক বলেন, চুক্তি সম্পাদনের পরই তারা টার্মিনালটি বুঝে নিয়ে অপারেশন শুরু করার প্রস্তুতি নেবে। অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে ২০ থেকে ২২ বছরের জন্য টার্মিনালটি দেয়া হচ্ছে। টার্মিনালের প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্টই তারা নিয়ে আসবে। নির্দিষ্ট সময়ের পরে এটি যেভাবে থাকবে সেভাবে বন্দর কর্তপক্ষের নিকট হস্তান্তর করে চলে যাবে এমন শর্তে সৌদি প্রতিষ্ঠানকে পিসিটি দেয়া হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২১ সালের ৩ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটি টার্মিনালটি পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এবং দুই দেশের সরকারের মধ্যে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব (জি–টু–জি) চুক্তির আওতায় পরিচালনার বিষয়টি নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়।
ওই বছরের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ ও সৌদি সরকারের প্রতিনিধিদলের এক ব্যবসায়িক সভায় পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। সৌদি সরকার রেড সি গেটওয়েকে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করে। প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটিকে মনোনয়নও দেওয়া হয়। ২৮ অক্টোবর সৌদি সরকারের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পিপিপি কর্তৃপক্ষের সমঝোতা স্মারক সই হয়।
চলতি বছরের ১১ মার্চ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রেড সি গেটওয়ের ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি সই হয়। ২৪ জুলাই রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড টার্মিনাল পরিচালনার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। পিপিপি কর্তৃপক্ষ সৌদি সরকারের প্রস্তাবের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে।
এরপর গত ৫ অক্টোবর পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে বেসরকারি অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে সৌদি সরকারের বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গ্রহণ করে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ সৌদি প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে চুক্তির প্রস্তুতি নিচেছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, চিটাগাং ড্রাইডক থেকে বোট ক্লাব পর্যন্ত আগেকার রাস্তাটি সোজা করে নদীর পাড়ে ২৬ একর জায়গায় বন্দর কর্তৃপক্ষ পিসিটি নির্মান করে। নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ করেছে দেশিয় প্রতিষ্ঠান ই–ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০২২ সালের মাঝামাঝি এর কাজ শেষ হয়।
৫৮৪ মিটার লম্বা এ টার্মিনালে তিনটি জেটি এবং পশ্চাদসুবিধা রয়েছে। তিনটিতেই একযোগে জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে। দুটিতে আমদানি–রফতানি পণ্যবোঝাই কন্টেনার জাহাজ এবং অপর ডলফিন জেটিতে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ বার্থিং নিতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে জেটিগুলোতে সচরাচর সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং নিয়ে থাকে। কিন্তু পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে ১০ মিটার ড্রাফটের এবং ২০০ মিটার ল্যান্থের জাহাজ বার্থিং নিয়ে পণ্য হ্যান্ডলিং করতে পারবে। ইতোমধ্যে গত বছরের ডিসেম্বর এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই দফায় সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার ল্যান্থের জাহাজ এই টার্মিনালে এনে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়।