চট্টগ্রামে গ্যাস সংকট এক যুগেরও অধিককাল ধরে চলে আসছে। চট্টগ্রামের প্রতি অবজ্ঞাসুলভ আচরণ ও চট্টগ্রামের বিনিয়োগকারীদের নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের অঙ্গীকার নিয়ে এবং চট্টগ্রামের আপামর মানুষের দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আলাদা গ্যাস বিপণন কোম্পানী গঠন করেন। নাম দেয়া হয় ‘কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি.’। নতুন কোম্পানী তার নতুন পথ চলা শুরু করলেও কাঙ্ক্ষিত গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। সেই শুরু থেকেই চট্টগ্রাম বিদ্বেষী এবং চট্টগ্রামের উন্নয়ন বিরোধী এক শ্রেণির কর্মকর্তার অসহযোগিতায় চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বার বার বাধাগ্রস্ত হয়। চট্টগ্রামের শিল্প বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প শুধুমাত্র গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। উৎপাদনে যেতে না পারার কারণে সরকারের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সরকার প্রধানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কারণে চট্টগ্রামের জন্য ৫০০ মিলিয়ন গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়ে হাজার হোজার কোটি টাকা ব্যয়ে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নেয়া হয়।
চট্টগ্রামকে সামনে রেখে এলএনজি আমদানি করা হলেও এর সুফল কখনো চট্টগ্রামবাসি পায়নি। চট্টগ্রামের চাহিদানুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না করে ন্যাশনাল গ্রিডের মাধ্যমে তা ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। চট্টগ্রামের গ্যাস ক্রাইসিস অবস্থায় যাতে ঢাকা হতে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ করা না যায় তার জন্য ন্যাশনাল গ্রিডের পাইপ লাইনে নন রিটানিং ভাল্ব স্থাপন করে চট্টগ্রাম বিরোধী কর্মকর্তারা। ফলে দেখা যায় চট্টগ্রামে সাইক্লোনের মহাবিপদ সংকেত দেয়া হলে নিরাপত্তার কারণে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলে পুরো চট্টগ্রামে গ্যাস সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। অচল করে দেয়া হয় চট্টগ্রামের সকল বাসাবাড়ি, শিল্প কারখানা ও সিএনজি স্টেশন। সে সংকটকালীন চট্টগ্রামের জন্য ন্যাশনাল গ্রিডের মাধ্যমে সামান্য পরিমাণও গ্যাস সরবরাহ করেনি জ্বালানি সেক্টরের বড় বড় পদে বসে থাকা কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের বিষয়ে যেন তাদের মাঝে বিশেষ এলার্জি রয়েছে। চট্টগ্রামের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে গঠিত কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লি. এর বোর্ডে চট্টগ্রামের কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই।
বর্তমানে বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। এ অবস্থায় এলএনজি সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি দেখা গেছে। কিন্তু এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে চট্টগ্রামের শিল্প কারখানায় রেশনিং করে চট্টগ্রামের নতুন উদ্যোক্তাদের গ্যাস সংযোগ না দিয়ে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে ব্যস্ত।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্প পার্ক স্থাপন করেছেন চট্টগ্রামের মিরেরশ্বরাই এলাকায়। সেখানে অনেক বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অনেকে উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশনা থাকলেও সেখানে গ্যাস সরবরাহে বাঁধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। অনেকদিন ধরে চট্টগ্রামের কোনও নতুন শিল্প কেজিডিসিএল বোর্ড অনুমোদন দেয়নি। শিল্প প্রতিষ্ঠানের বর্ধিত সংযোগের কার্য্যক্রমও বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
চট্টগ্রামকে যাতে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা দেয়া না যায় সে কারণে কয়েকদিন ধরে কেজিডিসিএল কোনও নিয়মিত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেই। ব্যবস্থাপনা পরিচালক না থাকার কারণে কেজিডিসিএল এর সকল প্রকার কর্মকাণ্ডে এক প্রকার স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে যেন কারো মাথাব্যথা নেই। চট্টগ্রামের ব্যবসায়িকদের স্বার্থ ও সুযোগ–সুবিধা নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে দেন দরবারের দায়িত্ব চট্টগ্রাম চেম্বারের। সেখানেও শুধু পদ নিয়ে টানাটানিতে সকলেই ব্যস্ত। এফবিসিসিআই এতে বর্তমানে চট্টগ্রামের মানুষ নেতৃত্বে রয়েছেন। সেখানে হতেও চট্টগ্রামের এ সংকটকালীন অবস্থা ও তা থেকে পরিত্রাণ ও সমাধানের জন্য কোনও কথা উচ্চারণ হতে শুনা যায়নি। আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে চট্টগ্রাম কি অভিভাবক শূন্য?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ২০৪১ প্রতিষ্ঠার জন্য এখন থেকে ‘ডিজিটাল টাক্সফোর্স’, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ টাক্সফোর্স’ হিসেবে কাজ করবে। স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভ ঠিক করা হয়েছে, এগুলো হলো–স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমিক ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। এ চারটি স্তম্ভের আলোকে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বাস্তবায়নের কনেক্টডিটি। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, ফ্রিল্যান্সারদের উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ এবং ইভেন্ট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজনে সরকার কাজ করলেও কাঙ্খিত ফলাফল আসছে না। প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা সদিচ্ছা বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন হয়েছে। ‘স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার সংযোগ’ স্লোগান বাস্তবায়িত হয়েছে থার্ড টার্মিনাল। ঢাকা ও কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক চলাচলের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো কয়েকটি মেঘা প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ঢাকা–ভাঙ্গা রেলপথ যা দক্ষিণঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ সুবিধা পাবে।
ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথ এবং কর্ণফুলী টানেলের ন্যায় বৃহৎ প্রকল্প এ মাসেই উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো–অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সহযোগিতায় এটি নির্মিত হচ্ছে। এ থার্ড টার্মিনাল চালু হলে বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রিকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এছাড়াও কক্সবাজারেও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজ সমাপ্তের পথে। অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা তথা কক্সবাজার হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের হাব।
ইতিমধ্যে দেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানের এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা হ্রাস করার লক্ষ্যে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
ইউরেনিয়ামের চালান হস্তান্তর ও সনদ প্রদানের মাধ্যমে এটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চ্যুয়াল ভাবে যোগ দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করেন। বর্তমানে এর ভৌতকাঠামো নির্মাণ শেষ পর্যায়ে। তিনটি পৃথক সঞ্চালন পাইপ নির্মাণ কাজও শেষের দিকে। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২ হাজার ৪ শত মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাবে। ১ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলার যা টাকার অংকে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি চালু হলে দেশের টেকসই জ্বালানি উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের জ্বালানি মিশ্রণের বৈচিত্র্য আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞমহল প্রত্যাশা করেন। বাংলাদেশ আজ পরমানু শক্তি ব্যবহারকারি দেশের তালিকায় ৩৩ তম।
দেশের আরেকটি মেঘাপ্রকল্পের উদ্বোধন হলো এবার ট্রেনে পদ্মা পাড়ি। ঢাকা–ভাঙ্গা রেলপথ উদ্বোধন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রেল যোগাযোগের আরেকটি ঐতিহাসিক উন্নয়নের কাজে পদ্মাসেতুকে পূর্ণতা দান করলেন। ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনটি অংশে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প। এ মাসের মধ্যেই উদ্বোধনের জন্য তৈরি আরো দু’টি মেগা প্রকল্প একটি হলো ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেল লাইন এবং অপরটি কর্ণফুলী টানেল দুটিই এখন সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২ কিলোমিটার ট্র্যাক নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে উদ্বোধন হবে এ মাসের শেষে। একই মাসে দেশের প্রথম টানেলও উদ্বোধন এবং উন্মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত যা এ মাসের ২৮ তারিখ উদ্বোধন হওয়ার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল হলো কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত নির্মাণাধীন সড়ক সুড়ঙ্গ। এ টানেলের মাধ্যমে ঢাকা–চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে যুক্ত হবে। ৩.৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ টানেল বাংলাদেশের প্রথম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম টানেল বা সুড়ঙ্গপথ। এছাড়াও ঢাকা এক্সপ্রেস ওয়ে এবং এমটিআর ট্রেন চলাচলের প্রকল্পও শেষ হয়েছে। যার সুফল জনগণ পাচ্ছে। বন্দর নির্মাণের কাজও শেষ পর্যায়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা তা আজ প্রকাশ্যরূপে সামনে এসেছে এবং জনগণ ইতিমধ্যে এর সুফল ভোগ করছে।
এরপরও দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। সরকারের সকল অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা উন্নয়ন বিরোধী কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের কর্মকাণ্ডের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। যেভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য এবং দেশের জ্বালানি খাতকে টেকসই করার লক্ষ্যে এলএনজির প্রকল্পের যে বিরূপ ব্যবহার তা আমাদেরকে বিস্মিত করছে। আমরা চাই সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সঠিক ব্যবহার এবং তার সার্বিক প্রচারণা খুবই জরুরি। অতি উৎসাহীরা যেভাবে চট্টগ্রামের শিল্পায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে তা যেন অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী।