লালন সাঁই (১৭৭৪–১৮৯০)। বাংলা লোক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক বাউল সাধনার পথিকৃৎ ও চারণ কবি। ধর্মীয় প্রভাব বলয়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ এবং মানবতারই পরম আরাধনা করেছেন তিনি। তাঁর গানে বার বার উদ্ভাসিত হয়েছে মানুষের মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠার বাণী। লালন সাঁইয়ের জন্ম ১৭৭৪ সালের ১৪ই অক্টোবর। তিনি ছিলেন সাধক, গায়ক, সুরকার, কবি। ছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধ একজন মানুষ। জনশ্রুতি রয়েছে, লালন জন্মেছিলেন হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। শৈশবে বাবা–মাকে হারালে এক তীর্থযাত্রী দলের সাথে বেরিয়ে পড়েন। এ সময় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে লালনকে পথে ফেলে অন্য যাত্রীরা চলে যায়। সিরাাজ সাঁই নামের এক মুসলমান সাধক তাঁকে নিজ বাড়িতে নিয়ে সেবা–শুশ্রুষা করে বাঁচিয়ে তোলেন। সিরাজ সাঁই ছিলেন লালনের প্রথম গুরু। স্বশিক্ষিত লালনের কবিত্বশক্তি, সমাজ–মনষ্কতা ও শিল্পচেতনা ছিল অসাধারণ। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। কিন্তু লালনের গানে ভাষা–সুর–অলংকা ে রর এমন শিল্পমণ্ডিত রূপ ভুলিয়ে দেয় তিনি নিরক্ষর, গ্রাম্য কবি। লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। যিনি ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবীসহ অসংখ্য মানুষকে।
তাঁর গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কণ্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল। তাঁর গানের মূল ভাবই হলো সত্য–শান্তি–সাম্য–সমপ্রীতি আর মানব কল্যাণ। ছিল তৎকালীন সময়ের মোল্লা–পুরোহিতদের অনুশাসনের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারাবদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা। লালনের গান কেবল বাঙালির লোকসমাজ ও নাগরিক জীবনের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই। লালন বিশ্ব নাগরিক এবং মানবতার প্রতীক। লালনের প্রায় ২৫০০টি গান রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেন। লালনের জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায়। এখানেই রয়েছে লালনের আখড়া। ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়া সারা বছরই মুখরিত থাকে লালন ভক্ত বাউলদের সাধনায়।এই আখড়াতেই ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর লালন সাঁই মৃত্যুবরণ করেন ।