দৈনিক আজাদী কেবল একটি সংবাদপত্র নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে আমার অপরিসীম ভালো লাগা ও ভালোবাসার সম্পর্ক।
দৈনিক আজাদী আজ সগৌরবে ৬৩ বছর পেরিয়ে ৬৪ বছরে পড়লো। এই গৌরব কেবল আজাদীর নয়, আমরা যারা আজাদীর লেখক–পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও গুণগ্রাহী প্রত্যেকেই এই আনন্দের অংশী। দৈনিক আজাদীর আমি যেমন একজন একনিষ্ঠ পাঠক, তেমনি পাশাপাশি একজনও লেখকও। “বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা” শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি গ্রন্থও আজাদীকে উৎসর্গ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও আমি ও মাছুম আহমেদ দৈনিক আজাদ ও দৈনিক আজাদী পত্রিকা নিয়ে গবেষণা করেছি।
বাংলা ও বাঙালির আত্ম–পরিচয়ের সংগ্রাম– জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ–স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সমস্ত বিপ্লব–বিদ্রোহের সূচকবিন্দুতে আজাদীর (চড়ংরঃরাব) ভূমিকা আজ ইতিহাসের গৌরবজনক অধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজতলা মহান একুশের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল এই পত্রিকায়। মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’– এ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল আজাদীর সূতিকাগার ‘কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসে’। সামিরক–জান্তার দমন–নিপীড়ন, অত্যাচারের মারাত্নক ঝুঁকি নিয়ে এই কবিতা প্রথম ছেপেছিল আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক। প্রেস ম্যানেজার নিজে কারাবরণ করে সম্পাদককে রক্ষা করেছিলেন। এছাড়া ৬২–৬৪’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৯’র গণ–অভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন থেকে শুরু করে ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল উত্তাল সময়ে আজাদী সিপাহ্সালারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। ৭০’র নির্বাচনে আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ হাই প্রোফাইল প্রতিদ্বন্দ্বী ফজলুল কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরম আস্থাভাজন।
স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে দৈনিক আজাদী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা হলো– ঐতিহাসিক ‘৬দফা’ আন্দোলনের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রাদেশিক সরকার তাদের প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে দেশের সব দৈনিক পত্রিকায় কিছু প্রবন্ধ সরবারহ করে তা প্রকাশ করতে বাধ্য করে। কিন্তু দৈনিক আজাদী তা প্রকাশ করলেও পরদিন তার জবাবে বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করে প্রবন্ধ ছাপে। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, দৈনিক আজাদী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ নিয়ে পরদিন প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক আজাদী’। সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোনো সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে– প্রান্তিক জনপদে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, যিনি এতদঅঞ্চলের প্রথম মুসলিম প্রকৌশলী। সেই ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ার দেশ ও জনগণের কল্যাণে মানুষের সুখ–দুঃখের বার্তা পৌঁছে দিতে বেছে নিলেন সংবাদপত্র প্রকাশ, তা–ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বেশিদিন আয়ু পাননি। তরপর এই পত্রিকার দায়িত্ব কাঁধে নেন তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং পুত্র এম. এ. মালেক। অনেক চড়াই–উৎরাই অতিক্রম করে আজাদী আজ এমন এক উচ্চতায় আসীন যা আঞ্চলিকতার গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় পত্রিকার পাশাপশি স্বমহিমায় অবস্থান করছে। আমাদের জন্য এটি অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় যে, এই পত্রিকার তিনজন কাণ্ডারি ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং বর্তমান সম্পাদক এম. এ. মালেক দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, একুশে পুরস্কার ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
আজাদীর মধ্যেই রয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তির অব্যর্থ নির্দেশনা। আজাদী কেবল সংবাদপত্রের নীতি ও দর্শন বিস্তারে নয়, প্রচার–প্রকাশ ও নিরপেক্ষতায়ও অকুণ্ঠ। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক অবজারভার যে মহিমায় ভাস্বর, চট্টগ্রামের আজাদীও তার সমতুল্য। বিভাগপূর্বকালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক জ্যোতি, দৈনিক পাঞ্চজন্য নামের দৈনিক সংবাদপত্র। কিন্তু এগুলো নিয়মিত ছিল না। দৈনিক আজাদী ৬ দশকেরও অধিককাল জুড়ে নিয়মিত প্রকাশনার গৌরবে দীপ্ত। এখন আজাদী ও চট্টগ্রাম বলা যায় সমার্থক। চট্টগ্রামকে তার রূপ–সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে আজাদীর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দৈনিক আজাদী মানুষকে সাহস জুগিয়েছে, উৎসাহিত করেছে। আমাদের সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে আজাদী অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে। সংবাদপত্র প্রকাশের নিরপেক্ষতায় আজাদী সকল মহলে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আজ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দাপটের যুগে যেখানে সংবাদপত্রের প্রিন্টেড ভার্সন হুমকির মুখে, সেখানে আজাদী তার প্রচারসংখ্যা স্বীয় গৌরবে অক্ষুণ্ন রেখেছে। এটা অত্যন্ত শ্লাঘার বিষয় যে, আজাদীর অনলাইন ভার্সন এখন সারা পৃথিবী জুড়ে সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।
আজাদী কেবল একটি গণমাধ্যম নয়, তা এখন একটি ইন্ডাস্ট্রিও। অবকাঠামো, প্রযুক্তি ও আধুনিকতায় বলা যায় সর্বতোভাবে হালফিল।
একটি আধুনিক সংবাদপত্রের যে মিশন ও ভিশন, যা নিউজ ও ভিউজের মধ্যে প্রতিফলিত, তা নিরঙ্কুশভাবে আজদীতে প্রতিভাত। বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করে আজাদী উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এম. এ. মালেক বলেন-“চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংবাদপত্র যখন ঢাকা থেকে সম্পাদক এনে বের করছে, আমাকে অনেকে ঢাকায় গিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। আমি কিন্তু রাজি হইনি। কারণ আমার বাবা জাতীয় পত্রিকা চাননি। আমরা বাইরে থেকে সাংবাদিক না এনে, চট্টগ্রাম থেকে সাংবাদিক নিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছি…। আমার ধারণা আমরা পাঠকের ৭০–৮০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে পেরেছি।”
বস্তুত, এ কথা যথার্থই আজাদীতে এসে সমবেত হয়েছেন। এমন অনেক কৃতিজন, তাঁদের মেধা ও মননঋদ্ধ এ পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়েছে উপর্যুপরি। আজাদীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন ও করছেন, তাদের মধ্যে বিশিষ্টজন– অরুণ দাশগুপ্ত, সিদ্দিক আহমদ, সাধন ধর, শরীফ রাজা, ওবায়দুল হক, কাজী জাফরুল ইসলাম, হাসান আকবর, রাশেদ রউফ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
সামগ্রিকভাবে আজাদীকে বলা যায় একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা। কেবল রিপোর্টিং’র ক্ষেত্রে নয়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, বিনোদন, হেরিটেজ রক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি সেক্টরেও আজাদী যুগোপযোগী রচনা প্রকাশ করে এসেছে।
এখন আজাদীর দায়িত্বে রয়েছে তৃতীয় প্রজন্ম ওয়াহিদ মালেক ও শিহাব মালেক। তাঁদের হাত ধরেই আজাদী নিশ্চয়ই আগামী সময়ের চ্যালেঞ্জ মেকাবিলায় এগিয়ে যাবে। আজাদীর বর্ষপূর্তিতে আমার অফুরান শুভকামনা। নিশ্চয়ই আজাদী তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। আমি/আমরা আজাদীর সঙ্গেই আছি। থাকবো। কেননা আজাদী আমারও ভালোবাসার সংবাদপত্র।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ