আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে ‘শিশুরা অপরাধ করে না, ভুল করে’। এজন্যে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু– কিশোরদের যেন কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া না হয়। এটা সমস্যার সহজ সমাধান নয়। এ ধরনের শিশু– কিশোরদের স্থান সর্বপ্রথমে কারাগার নয়। অভিভাবক কিংবা সংশোধনাগার বা উন্নয়ন কেন্দ্রে রেখে এদের সংশোধন করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারাগারে পাঠানো যেন কারো লক্ষ্য না হয়। অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোর–কিশোরীদের এজাহার ও পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ে প্রকৃত বয়স উল্লেখ না করায় তারা শিশু আইনের সুবিধা পায় না। এমন কি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। যেখানে শিশুর বয়স সঠিকভাবে উল্লেখ করলে এই ধরনের দণ্ড থেকে রেহাই পেতো। মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন– বিএইচআরএফের একটি তদন্ত টিম কর্তৃক ঢাকা সিএমএম আদালতের মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় এসংক্রান্ত চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছিল। এতে দেখা গেছে, ঢাকা কারাগারে আটক শিশু–কিশোর ও কিশোরীদের প্রকৃত বয়সের সাথে সংশ্লিষ্ট মামলার এজাহার বা পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখিত বয়সের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট এলিনা খান এসব শিশু–কিশোরের বয়স নির্ধারণের জন্য ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে একটি আবেদন শুনানি করেন। শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোরদের প্রকৃত বয়স নির্ধারণের জন্য মেডিক্যাল পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মেডিক্যাল পরীক্ষা করার পর দেখা যায় যে, এজাহার বা পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোরদের উল্লিখিত বয়সের সাথে মেডিক্যাল রিপোর্টের বয়সের বিস্তর ব্যবধান। এসংক্রান্ত ১৪ জন শিশু–কিশোরের বয়সের গরমিল প্রতীয়মান হয়। এর ফলে যেসব অনিয়ম ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:- মামলার এজাহারে ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোর–কিশোরীদের প্রকৃত বয়স উল্লেখ করা হচ্ছে না। ২. পুলিশ কর্তৃক শিশু– কিশোর–কিশোরীরা ধৃত হওয়ার পর তাদের প্রকৃত বয়স নির্ধারণ করে পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ে উল্লেখ করা হচ্ছে না। ৩. থানা থেকে পাঠানো শিশু–কিশোর–কিশোরীদের আদালতে আনার পর কোর্ট হাজত থেকে আদালতে প্রায় সময় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে না। অনেক সময় নথি উপস্থাপনের ফলে বিজ্ঞ আদালত নথিতে উল্লিখিত বয়স দেখেই তাদের জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। অর্থাৎ, অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোর–কিশোরীদের প্রকৃত বয়স নির্ধারিত না হয়ে শুধু এজাহার বা ফরোয়ার্ডিংয়ের ওপর ভিত্তি করে আবার জেলখানায় পাঠানো হচ্ছে।৪. অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোর–কিশোরীদের জেলখানায় পাঠানোর পর জেল কর্তৃপক্ষ বয়স নির্ধারণের পর দেখা যায়, এজাহার ও পুলিশ ফরোয়ার্ডিংয়ের বয়সের সাথে জেল কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ৫. আইনের জটিলতার কারণে অতি দ্রুত প্রকৃত বয়স নির্ধারণ করে কারাগার থেকে শিশু–কিশোর–কিশোরীদের উন্নয়ন কেন্দ্রে প্রেরণের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে। ৬. যেহেতু ২০১৩ সালের শিশু আইন মোতাবেক অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া কোনো শিশু–কিশোর–কিশোরী কারাগারে আটক থাকবে না, তাই তাদেরকে উপযুক্ত সংশোধনাগার বা উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। যদিও দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে সরকারি কোনো কারেকশন সেন্টার নেই, তাই গাজীপুরই একমাত্র ভরসা, শিশু আসামীরা পরিবার থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে আর হয়রানির শিকার হচ্ছে। বয়সের তারতম্যের কারণে জেলখানায় প্রাপ্ত বয়স্ক হাজতিদের সাথে আটক থেকে একদিকে যেমন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে অপরদিকে শিশু–কিশোর–কিশোরীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত এবং এদের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে আইনি জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোর–কিশোরীরা প্রকৃত আইনে বিচার না পেয়ে অনেক ক্ষেত্রে জেল, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেরও সম্মুখীন হতে পারে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়। কারণ শিশু–কিশোররা অপরাধ করে না ভুল করে তাই তাদেরকে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। তাই একটি বিভাগীয় শহরে শিশু–কিশোর–কিশোরীদের সংশোধনাগার বা উন্নয়ন কেন্দ্রে রেখে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রবেশন, প্রবেট, প্যারোলসহ অনুকম্পা, চরম গুডটাইম ল–এর সব সুবিধা দিতে হবে। দয়া, ক্ষমা, অনুকম্পা ও সহানুভুতির দৃষ্টিতে তাদের জীবনমান উন্নয়নে সহযোগিতা দিতে হবে। শিশু আইনের বিধান মতে জামিন অযোগ্য ধারায়ও থানার ও.সি জামিন দিতে পারেন। কিন্তু তারা এটাকে ঝামেলা মনে করে শিশুর বয়স বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ আসামীদের সাথে ফরোয়ার্ডিং করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে শিশু–কিশোরদের বিচার জুরি ট্রায়েল ও ক্যামেরা ট্রায়েল করা যায়। অন্যথায় মানবাধিকারের লঙ্ঘনসহ আইনের শাসনও সুশাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হবে। শিশু ও কিশোরেরা জেলখানায় বয়স্ক অপরাধীদের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনকে কঠোরভাবে দৃষ্টি রেখে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাথে সাথে এ ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারক, বিজ্ঞ এডভোকেট, ভিজিটর সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও সমাজ সচেতন নাগরিকদের যুগপৎ ভূমিকা রাখতে হবে। বিশেষ করে অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া শিশু–কিশোরদের‘ যেন কিশোর অপরাধী‘ বলে আখ্যায়িত করা না হয়। সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আইনে নিরাপত্তা হেফাজত‘ নামে কোনো জিনিস নেই। সুতরাং নিরাপত্তা হেফাজতের নামে কোনো নারী, শিশু কিংবা কিশোর–কিশোরী যেন কারাগারে প্রেরিত না হয়। কেননা এতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় চরমভাবে। হাটহাজারির ফরহাদাবাদে মহিলা ও শিশু–কিশোর হেফাজতিদের সরকারি নিরাপদ আবাসন (সেফ হোম) রয়েছে, সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তর এটা পরিচালনা করে।
নারী ও শিশু অধিকার রক্ষায় আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই মানবাধিকার সংগঠন কাছে বিএইচআরএফ চট্টগ্রাম শাখা কুড়িয়ে পাওয়া শিশু–কিশোর মামলার ভিকটিমদের জিম্মায় গ্রহণপূর্বক তাদের অভিভাবকদের পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তাদের অভিভাবক না পেলে শেল্টার হোমগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। চট্টগ্রামে সরকারি এমন নিরাপদ আবাসন রয়েছে ১১টি। জাতিসঙ্ঘ শিশু সনদ ও শিশু আইনের বিধানমতে কোনো শিশু–কিশোর জেলহাজতে যাবে না। ১৮ বছরের কম অথচ অপরাধের সাথে জড়িত, আটক শিশু–কিশোর/কিশোরীদের প্রবেশনে অথবা অভিভাবকের জিম্মায় ব্যাপারে বিএইচআরএফ– এর সাথে যোগাযোগ করুন। শিশু আইন, ২০১৩ এবং জাতিসংঘ শিশু সনদ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট্স ফাউন্ডেশন–বিএইচআরএফ সবার সহায়তা কামনা করছে। সাথে সাথে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত ১টি করে শিশু সংশোধানাগার স্থাপণের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সুদৃষ্টি কামনা করছে।
লেখক : আইনজীবী, সুশাসন ও মানবাধিকার কর্মী।